একাত্তর

১৯৭০ সালে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান আর ‘সোনার বাঙলা শ্মশান কেন’ পোস্টার যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল। তার জোয়ারে ভেসে গেল অন্যরা।

উত্তরে উত্তুঙ্গ গিরি

দক্ষিণেতে দুরন্ত সাগর

যে দারুণ দেবতার বর,

মাঠভরা ধান দিয়ে শুধু

গান দিয়ে নিরাপদ খেয়া–তরণীর

পরিতৃপ্ত জীবনের ধন্যবাদ দিয়ে

তারে কভু তুষ্ট করা যায়।

ছবির মতন গ্রাম

স্বপনের মতন শহর

যত পারো গড়ো,

অর্চনার চূড়া তুলে ধরো

তারাদের পানে;

তবু জেনো আরো এক মৃত্যুদীপ্ত মানে

ছিলো এই ভূখণ্ডের,

ছিলো সেই সাগরের পাহাড়ের দেবতার মনে।

সেই অর্থ লাঞ্ছিত যে, তাই,

আমাদের সীমা হল

দক্ষিণে সুন্দরবন

উত্তরে টেরাই।


এই পঙ্​ক্তিমালায় প্রেমেন্দ্র মিত্র যে ছবি এঁকেছেন, তা বাংলাদেশ। ‘পুণ্ড্র–গৌড়–সুহ্ম–রাঢ়–তাম্রলিপ্তি–সমতট–বঙ্গ–বঙ্গাল–হরিকেল ইত্যাদির ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করিয়া এক অখণ্ড ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য সম্বন্ধে যখন আবদ্ধ হইল, যখন বিভিন্ন স্বতন্ত্র নাম পরিহার করিয়া এক বঙ্গ বা বাঙলা নামে অভিহিত হইতে আরম্ভ করিল, তখন বাঙলার ইতিহাসের প্রথম পর্ব অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। প্রাচ্যদেশীয় প্রাকৃত ও মাগধী প্রাকৃত হইতে স্বাতন্ত্র্য লাভ করিয়া, অপভ্রংশ পর্যায় হইতে মুক্তিলাভ করিয়া বাঙলা ভাষা যখন তাহার যথার্থ আদিম রূপ প্রকাশ করিল তখন আদিপর্ব শেষ না হইলেও প্রায় শেষ হইতে চলিয়াছে। এই জন ও ভাষার একত্ব–বৈশিষ্ট্য লইয়াই বর্তমান বাংলাদেশ...’ (বাঙালীর ইতিহাস: আদি পর্ব, নীহাররঞ্জন রায়)।

নীহাররঞ্জন রায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্র যে ভৌগৌলিক অঞ্চলের কথা বলেছেন, তা আর অবিভাজ্য নেই। স্যার সিরিল র​্যাডক্লিফের কাঁচিতে কাটা পড়ে কয়েকটি জেলা নিয়ে ১৯৪৭ সালের আগস্টে তৈরি হওয়া প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ঢুকে গেছে নতুন বানানো পাকিস্তান রাষ্ট্রের পেটে। নানান চড়াই–উতরাই পার হয়ে পূর্ববঙ্গ হলো পূর্ব পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশ।

রাষ্ট্র তৈরি হওয়া মানেই রক্তপাত। অনেক বঞ্চনা, আর্তনাদ, অশ্রু, উদ্বাস্তু আর প্রাণঘাতী যুদ্ধ রাষ্ট্র তৈরির অন্যতম অনুষঙ্গ। এ রকম একটা পথ পাড়ি দিয়েই এসেছে বাংলাদেশ। এর আছে নানান ধাপ, নানান পর্ব। ১৯৭১ সালে এসে এটি এমনভাবে দানা বাঁধে যে, তা থেকে সরে আসার আর উপায় ছিল না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অনিবার্যতা ১৯৪০, ১৯৪৬, ১৯৪৭ এমনকি ১৯৭০ সালেও যাঁরা বোঝেনিন, তাঁরা রাজনীতিকে দেখেছেন দাবাখেলার টেবিল হিসেবে। তাঁরা ইতিহাসের বাস্তবতা বোঝেননি এবং মানুষের মন পড়তে পারেননি।

একাত্তরে এই দেশে একটা যুদ্ধ হয়েছিল। এর আগে এদেশের মানুষ যুদ্ধ দেখেনি। যুদ্ধ যে কত ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। একটি যুদ্ধের আহ্বান জানানো বা উন্মাদনা জাগিয়ে তোলা খুব সহজ। কিন্তু তাতে যুদ্ধ বাঁধে না। যুদ্ধে একপক্ষ অন্যপক্ষকে আক্রমণ করে। অন্য পক্ষ আত্মসমর্পণ করে, নতজানু হয়, অধীনতা মেনে নেয়। এটাই ছিল এ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের ইতিহাস। রাজা গেছে, রাজা এসেছে। সাধারণ মানুষ তা নিয়ে খুব একটা ভাবেনি। তাদের অবস্থা থেকে গেছে অপরিবর্তিত। পরাজিত শাসকের জন্য ভাবাবেগ বা বিলাপ এবং জয়ীর জন্য বন্দনা ছিল খুবই সীমিত। এবং তা হয়েছে অনেক পরে। আকবর বাদশাহ কত মহান ছিলেন, কিংবা ওয়ারেন হেস্টিংস কত নিষ্ঠুর ছিলেন, যেসব অনেক পরে লেখা হয়েছে। সেসব পড়ে আমরা কাউকে বানাই নায়ক, কাউকে খলনায়ক।

একাত্তরের প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। বাঙালি মুসলমান ভালোবেসে পাকিস্তান বানিয়েছিল। আগ বাড়িয়ে অতিপ্রেম দেখাতে গিয়ে নিজ শক্তি বিসর্জন দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সংখ্যা–সাম্য নীতি গ্রহণ করেছিল। হুঁশ হলো অনেক পরে। তখন একটাই মূল দাবি—স্বায়ত্তশাসন চাই। সেটাও হতে হবে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। এর ধারাবাহিকতায় এল ছয়দফা কর্মসূচি। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এতে প্রজন্মকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল স্বাধীনতার মন্ত্রে। জনতা রাজপথে তৈরি করল স্লোগান—তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা–মেঘনা–যমুনা, পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা। তরুণদের একটা বড় অংশের মনোজগত থেকে নির্বাসিত হলো পাকিস্তান।

১৯৭০ সালে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান আর ‘সোনার বাঙলা শ্মশান কেন’ পোস্টার যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল। তার জোয়ারে ভেসে গেল অন্যরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান হলো বাঙালির স্বার্থরক্ষাকারী প্রধান ও একমাত্র নেতা হিসেবে। ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি পেলেন একচেটিয়া ম্যান্ডেট, যা তাঁকে করে তুলল আরও আত্মবিশ্বাসী, সাহসী ও একরোখা। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে সুতোটি ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সমঝোতার মাধ্যমে একটা সমাধান, পাকিস্তানের দুই অংশের দুটি আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটি কনফেডারেশন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ীরা এটা চায়নি। তারা একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিল। বাঙালি যুদ্ধ চায়নি। যুদ্ধ যখন ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল, তখন শুরু হলো জনতার প্রতিরোধ। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে সমাজের সব অংশের মানুষ শামিল হলেন—পুলিশ, ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক নারী–পুরুষ নির্বিশেষে। এ এক অভিনব জন্মযুদ্ধ, যা এই অঞ্চলে এর আগে কেউ দেখেনি। মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া এই যুদ্ধ সবার মনকে ছুঁয়ে গেছে। সবাই সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য তৈরি। এ এক অভাবনীয় প্রণোদনা, স্বাধীনতার এক আকাশছোঁয়া আকাঙ্ক্ষা, থাকে কোনো শক্তিই দমিয়ে রাখতে পারে না।

এই যুদ্ধ শেষ হলো ২৬৬ দিনে। এর মধ্যে সরাসরি যুদ্ধে নেমেছে ভারতের সামরিক বাহিনী। তারা ১৩ দিনের যুদ্ধে পুরো দেশ কবজায় নিল। আমাদের সমর্থনে তারা এসেছিল বলে আমরা তাদের বলি ‘মিত্রবাহিনী’।

এ নিয়ে আছে একাধিক ডিসকোর্স। ভারতের অনেক বুদ্ধিজীরা এবং সমরনায়ক মনে করেন, তারা ১৩ দিনের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন করে দিয়েছেন। ১৯৪৮ ও ১৯৬৫ সালে দু–দুটো যুদ্ধে পাকিস্তানের এক ইঞ্চি জমিও ভারত দখলে নিতে পারেনি। ১৯৭১ সালে তারা কীভাবে পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্যকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করালো? এখানেই রয়ে গেছে সূত্র। জনযুদ্ধের ফলে পাকিস্তানিরা গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিল, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে আটকে পড়েছিল সেনানিবাস ও শহরগুলোয়। গ্রামগুলো প্রায় সবই ছিল স্বাধীন। মিত্রবাহিনী তাতে দিল ‘ফিনিশিং টাচ’। এটি করতে লেগেছিল ১৩ দিন।

চীনের কমিউনিস্ট পার্ট এবং পাকিস্তানের সমরনায়ক ও রাজনীতিবিদদের বড় অংশটি এখনো মনে করে, সোভিয়েত রাশিয়ার মদদে ভারত পাকিস্তান ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ তৈরি করে দিয়েছে। বাংলাদেশের মাওবাদীরাও এরকমটি মনে করেন। বাংলাদেশের মানুষের লড়াই আর আত্মত্যাগের ইতিহাস তাদের দলিলে অনুপস্থিত।

এটা ঠিক, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারতের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা চলে ‘ইন্সট্রুমেন্টাল’। ভারত সীমান্ত খুলে না দিলে; আশ্রয়, খাবার, অস্ত্র না দিলে কী হতো তা নিয়ে অনেক তর্ক হতে পারে। ভারতের অন্যরকম ‘গেমপ্ল্যান’ ছিল। তারা তাদের লক্ষ্য হাসিল করেছে। আমরা যা চেয়েছিলাম, তা পেয়েছি। ভারতের লক্ষ্য এবং বাঙালির আকাঙ্ক্ষা একাত্তরে এসে এক মোহনায় মিলে গিয়েছিল। এ নিয়েও তৈরি হয়েছে টানাপোড়েন। এ বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি অ্যাকাডেমিক আলোচনা হয় না।

বাংলাদেশ হতোই। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে কয়েকটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ছিল। ১৯৪৭ সালে হয়েছে একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান। হাজার মাইল দূরে দেশের দুটি অংশ, ভাষা–সংস্কৃতির যোজন যোজন ব্যবধান সত্ত্বেও কৃত্রিম স্লোগানের ওপর টিকে ছিল দেশটি ২৩ বছর। ভাঙন ছিল অনিবার্য। একটা পর্যায়ে এসে ভারত অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে।

একাত্তরের মুক্তি যুদ্ধে অনেকগুলো পোস্টার তৈরি হয়েছিল। তার একটি হচ্ছে:


বাংলার হিন্দু

বাংলার বৌদ্ধ

বাংলার খৃষ্টান

বাংলার মুসলমান

আমরা সবাই বাঙালি।

এই পোস্টারের শব্দরাজি এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এর হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। মনোজগতে এখনো রয়ে গেছে পাকিস্তান। লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানের আলাদা রাষ্ট্র ঘোষণায় অঙ্গীকার ছিল। সেটাই পরে তৈরি করে দিয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ভিত। সেখান থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক