১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বিশ্বে নজিরবিহীন। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড চলে। বধ্যভূমিতে অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ৬৪ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধারাবাহিকভাবে থাকবে প্রথম আলোর নাগরিক সংবাদে। আজ থাকছে বরগুনা ও পটুয়াখালীর গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
বরগুনা
বিষখালী নদী বধ্যভূমি,পাথরঘাটা
১৯৭১ সালের ১৪ মে শুক্রবার পাকিস্তানি বাহিনী বরগুনা শহর দখল করে। ১৫ মে পাকিস্তানি বাহিনী বরগুনার পাথরঘাটায় বিষখালী নদীর তীরে গণহত্যা চালায়। পটুয়াখালীর ডিএমএলএ মেজর নাদের পারভেজের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনী কয়েক শ লোককে গুলি করে হত্যা করে বিষখালী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। বিষখালী এক রক্তের নদীতে পরিণত হয়।
জেলখানা বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১৭ মে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা স্পিডবোটে বরগুনা শহরে এসে এখানকার বিভিন্ন এলাকা ঘেরাও করে নারী-পুরুষ-শিশুকে বেঁধে জেলখানায় আটকে রাখে। ২৯ ও ৩০ মে জেলখানার ভেতর গুলি করে ৭৬ জনকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনী মৃত ও অর্ধমৃত ব্যক্তিদের জেলখানার পশ্চিম পাশে গর্ত করে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। স্বাধীনতার পরপরই এই গণকবর খোঁড়া হয় এবং পুনরায় তাঁদের দাফন করা হয়।
পিডব্লিউডি ডাকবাংলো বধ্যভূমি
বরগুনায় পিডব্লিউডি ডাকবাংলো ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি নির্যাতন ও হত্যাকেন্দ্র। ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে এখানে পাকিস্তানি বাহিনী শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য বাঙালিকে ধরে এনে আটকে রাখে এবং তাঁদের ওপর নির্যাতন চালায়। তারা এখানে জেলখানা থেকে বহু যুবতীকে ধরে এনে ধর্ষণ করত।
পটুয়াখালী
মাতবর বাড়ির গণকবর
১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পটুয়াখালীতে আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এখানে দীর্ঘ আট মাসে তাদের সহযোগী রাজাকারদের সহযোগিতায় শত শত বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করে। এ সব শহীদের লাশ কিছু তাঁদের আত্মীয়স্বজন নিয়ে গিয়ে দাফন করেন। বাকি লাশগুলো মাতবর বাড়ির গণকবরে দাফন করা হয়।
কালিকাপুর গণকবর
পটুয়াখালীর কালিকাপুরের গণকবরে অসংখ্য নাম না-জানা মানুষের গণকবরে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর এই গণকবরটি আবিষ্কৃত হয়।
জেলা প্রশাসক বাসভবন গণকবর
পটুয়াখালীতে জেলা প্রশাসকের বাসভবনের দক্ষিণ পাশে রয়েছে গণকবর। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ আনসারদের এই গণকবরে দাফন করা হয়েছিল।
পুরোনো জেলখানা বধ্যভূমি
পটুয়াখালী শহরের পুরোনো জেলখানার অভ্যন্তরে পাওয়া গেছে বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান। জেলখানার গণকবরের প্রতিটিতে চার-পাঁচজন করে মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। অনুমান করা হয়, জেলের অভ্যন্তরে ন্যূনতম ৫০০ লোককে হত্যা করে বিভিন্ন গর্তে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এঁদের অধিকাংশকেই গুলি করে হত্যা করা হয়। জানা যায়, জেলের প্রাচীরের ধার ঘেঁষে লাইন দিয়ে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করা হয়। জেলের প্রাচীরে পাওয়া গেছে অসংখ্য বুলেটের চিহ্ন। বেলা দুইটা থেকে পাঁচটার মধ্যে এসব হত্যাকাণ্ড চালানো হতো। জানা যায়, মেজর নাদির পারভেজের নির্দেশেই নাকি এক দিনেই ৬০-৭০ জনকে জেলের অভ্যন্তরে হত্যা করা হয়।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ’৭১-এর গণহত্যা ’৭১, সম্পাদিত আবু সাঈদ; ‘একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর’, সুকুমার বিশ্বাস; ‘যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ’, ডা. এম এ হাসান; ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’, দ্বিতীয় ও চতুর্থ খণ্ড
* বরগুনা ও পটুয়াখালীর গণহত্যা, গণকবর কিংবা বধ্যভূমিসংক্রান্ত আরও যদি খবর থাকে, অনুগ্রহ করে মেইলে জানাবেন।
আবু সাঈদ: কবি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
[email protected]
আরও পড়ুন