এখনো চুপচাপ স্বাস্থ্যের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

জাতীয় সংসদ ভবন
ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির পর গত ৩১ মে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছু খুলে দিয়েছে সরকার। এখনো সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না এলেও প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ব্যতিক্রম শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তারা এখনো নীরব। অথচ করোনা মহামারির এই সময়ে তাদেরই সবচেয়ে বেশি তৎপর থাকার কথা ছিল। কিন্তু এই কমিটি একটি বৈঠকও করেনি।

জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় কমিটির কাজ হলো কমিটির আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা এবং সংসদ থেকে পাঠানো বিল বা যেকোনো বিষয় পরীক্ষা করা। নিয়ম অনুযায়ী, কমিটিকে মাসে অন্তত একটি বৈঠক করতে হবে।

গত মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি বৈঠক করেছে স্বাস্থ্যের সংসদীয় কমিটি। অথচ দেশে গত মার্চে করোনার সংক্রমণের শুরু থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা চললেও এই কমিটির নীরব থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পর্যালোচনা বা অনিয়মের কোনো অভিযোগ তদন্তের উদ্যোগ নেয়নি এই কমিটি।

সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, গত ২৪ মার্চ সর্বশেষ বৈঠক করেছিল স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বৈঠকে দেশে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ওই বৈঠকে করোনায় আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) সরবরাহে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, আইসোলেশনের (বিচ্ছিন্ন রাখা) পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা এবং হাসপাতালগুলোতে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) সুবিধা কতটা রয়েছে, তা দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। করোনাকালে কার্যত এটুকুই এই কমিটির ভূমিকা।

করোনার সংক্রমণের আগে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। কমিটির সূত্র জানায়, গত বছরের ২০ নভেম্বর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মালামাল কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে একটি উপকমিটি গঠন করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটি তাদের তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দিয়েছে। কিন্তু মূল কমিটির বৈঠক না হওয়ায় এখনো প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়নি।

ওই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সাংসদ মুহিবুর রহমান (মানিক)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অনেক আগেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। মূল কমিটির বৈঠক হলে তা নিয়ে কমিটিতে আলোচনা হবে, কমিটি সুপারিশ দেবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এই সদস্য বলেন, করোনার এই সময়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠক হওয়াটা জরুরি ছিল। কিন্তু নানা কারণে বৈঠক হয়নি। তাঁরা আশা করছেন, দ্রুত কমিটির বৈঠক ডাকা হবে। তিনি বলেন, বৈঠক না হলেও কমিটির সদস্যরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখছেন।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানানো হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী, চিকিৎসাসামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অনিয়ম এবং করোনার পরীক্ষায় অনিয়মের একাধিক ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানানো হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী, চিকিৎসাসামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অনিয়ম এবং করোনার পরীক্ষায় অনিয়মের একাধিক ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ধরনের অভিযোগে একাধিক মামলা করেছে। কিন্তু বৈঠক না হওয়ায় স্বাস্থ্যের সংসদীয় কমিটিতে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ তৈরি হয়নি।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সরকারি ছুটি ছিল। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ থেমে ছিল না। পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজনীয় মন্ত্রণালয়গুলোর কাজও সীমিত পরিসরে চলেছে। ছুটির ওই দুই মাসে কোনো সংসদীয় কমিটির বৈঠক হয়নি। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, ছুটির পর জুন মাসে আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ছাড়া আর কোনো সংসদীয় কমিটি বৈঠক করেনি। মূলত জুলাই মাস থেকে সংসদীয় কমিটিগুলো আবার বৈঠক শুরু করে। করোনার সংক্রমণের মধ্যেই জাতীয় সংসদের তিনটি অধিবেশন বসেছে। কিন্তু বসেনি স্বাস্থ্যের সংসদীয় কমিটি।

কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, কমিটির সভাপতি বৈঠক আহ্বান করে থাকেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সরকারি দলের জ্যেষ্ঠ সাংসদ শেখ ফজলুল করিম সেলিম। দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস কমিটির কোনো বৈঠক না হওয়ার কারণ জানতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের একাধিকবার চেষ্টা করা হয়। তবে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এই নিষ্ক্রিয়তা হতবাক করেছে। স্বাস্থ্যে দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সেখানে সংসদীয় কমিটি কীভাবে একেবারে নীরব থাকতে পারে? তারা নিয়মিত বৈঠকও করছে না।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)

জাতীয় সংসদ ও সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করে আসছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এই নিষ্ক্রিয়তা হতবাক করেছে। স্বাস্থ্যে দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সেখানে সংসদীয় কমিটি কীভাবে একেবারে নীরব থাকতে পারে? তারা নিয়মিত বৈঠকও করছে না। তিনি বলেন, হতে পারে তারা এসব বিধিবিধান গুরুত্ব দেয় না। অথবা দুর্নীতি অনুসন্ধান করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। কারণ অনেকের যোগসাজশে দুর্নীতি হয়েছে। অথবা এমনও হতে পারে, যারা বিভিন্ন দুর্নীতির মূলে রয়েছে, তাদের কাউকে কাউকে সুরক্ষা দিতে কমিটি নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে।