এখনো প্রতীক্ষায় স্বজনেরা

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় একসঙ্গে দুই সন্তানকে হারিয়েছেন মা আনোয়ারা বেগম। কিন্তু তাঁদের লাশ দেখতে পাননি। জানেনও না কোথায় দেওয়া হয়েছে প্রিয় সন্তানদের কবর। চার বছর ধরে প্রতীক্ষা করছিলেন, কেউ একজন ফোন করে জানাবেন যে মেয়ে ঝুমা ও ছেলে হাবীবুরের লাশ পাওয়া গেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কারও ফোন পাননি আনোয়ারা, হয়তো আর পাবেনও না।

গতকাল রোববার এই প্রতিবেদক ফোন করলে কান্নায় ভেঙে পড়েন আনোয়ারা বেগম। পরিচয় দিতেই জানতে চাইলেন সন্তানদের কোনো খবর পাওয়া গেল কি না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, ‘চারটা বছর ধরে ভাবতেছি কেউ ফোন কইর‍্যা মাইয়া-পোলার লাশ পাওয়ার খবর দিব, কিন্তু কোনো খোঁজখবর পাইলাম না। বাচ্চা দুইটার কবরের সামনে গিয়ে কানতে পারলে আমার মনডায় একটু শান্তি পাইতো।’

রানা প্লাজা ধসে কাশেম আলী হারিয়েছেন পরিবারের তিন সদস্যকে। বড় ছেলে উজ্জ্বল, পুত্রবধূ খাদিজা আর ছোট ছেলে আফজাল ওই দিন (২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল) রানা প্লাজার তিনতলায় কাজ করছিলেন। উজ্জ্বলের মা সালমা বেগমের মুঠোফোনে ফোন করলে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘এক ছেলে আর তার বউয়ের লাশ তো পাইলাম, আরেক ছেলের লাশ কই গেল। ছোট পোলাডার লাশ কি পাওয়া যাবে, কোথায় কবর হইছে আমার পোলাডার?’

একইভাবে নিহত শায়লা আক্তার, বেলাল হোসেন, শারমীন হোসেন, মর্জিনা বেগমের পরিবারের সদস্যরা অন্তত প্রিয়জনের কবরটা দেখতে চান। তাঁরা স্বজনের লাশ খুঁজেছেন সাভারের হাসপাতালগুলোতে, ঢাকা মেডিকেলের মর্গে বা মিটফোর্ডে। কিন্তু সন্ধান পাননি। সবার একটাই কথা, আজীবন স্বজনের লাশের অপেক্ষায় থাকবেন তাঁরা।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত সহস্রাধিক ব্যক্তির মধ্যে সব মিলিয়ে ১০৩ জনের লাশ এখনো শনাক্ত হয়নি। এসব লাশ কবর দেওয়া হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে। এসব লাশের পরিচয় পাওয়ার আর কোনো সুযোগও নেই বলে জানা গেছে। এসব লাশের পরিচয় অশনাক্ত রেখেই শেষ করা হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষা। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য দেওয়া নমুনার সঙ্গে মিল রেখে কবরে একটি শনাক্তকরণ নম্বর দেওয়া হয়েছিল। ওই শনাক্তকরণ নম্বর প্লেট মুছে গেছে। মুছে গেছে নামের ফলকও।

শ্রম মন্ত্রণালয়ে থাকা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী রানা প্লাজা ধসের পর প্রথমে শনাক্ত না হওয়া ৩২২ জনের মধ্যে মোট ২০৬টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হয়। পরে স্বজন দাবি করে আরও চারজন রক্তের নমুনা দেন ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। এতে দুজনের লাশের ডিএনএর সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৩২২টি নমুনা দেওয়া হলেও ১১ জনের নমুনা দুবার করে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ অশনাক্ত লাশের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ৩১১।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা ধসে মৃত অশনাক্ত ব্যক্তিদের ডিএনএ আর পরীক্ষা করা হবে না। ডিএনএ পরীক্ষায় অংশ না নেওয়া পোশাককর্মীর পরিবারের সদস্যদের গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু কারও সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি।

জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির কর্মকর্তারা বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে মৃত ব্যক্তিকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের আগে অবশ্যই ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। না হলে এমন গরমিল হবেই। তাঁরা বলেন, একজনের মরদেহ অন্যজনের আত্মীয়ের নিয়ে যাওয়ার কিছু ঘটনা তাঁরা তখন জেনেছিলেন। সে সময় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও লাশ দাবিদার স্বজনদের সঠিকভাবে যাচাই করতে পারেনি, হয়তো সম্ভবও ছিল না।

ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির প্রধান শরীফ আক্তারুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে লাশ দেওয়ার আগেই ৮১২ লাশ তাঁদের স্বজনেরা ভালো করে না দেখেই নিয়ে যান। ওই সময় লাশের গরমিল হয়েছে। একে অন্যের লাশ নিয়ে যাওয়ায় এতসংখ্যক ডিএনএ মেলেনি। এখন পুনরায় যদি এসব ডিএনএ মেলাতে হয়, তবে সব লাশ কবর থেকে তুলতে হবে, যা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।’

উল্লেখ্য, ডিএনএ বিশ্লেষণে বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে সহযোগিতা করেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)।

গত বছরের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন।