‘এখানে যে মানুষ আছে, সরকার কি তা জানে?’

নদীতে অর্ধেক ঝুলন্ত এ ঘর নারী, শিশু নিয়ে এক পরিবারেরছবি: প্রথম আলো

‘বাসন্তী’র সুসময় ছিল অনেক দিন। গ্রামের সুখবর উদ্‌যাপনে বড় মাটির চুলায় টগবগ করত চিনির শিরা। কালো চমচমের সঙ্গে সাদা রসগোল্লার প্রতিযোগিতা হতো ক্রেতার পাতে। আইলা আর আম্পানের মতো বড় ধকলেও টিকে যাওয়ায় মালিক অধর বাওয়ালির আস্থা ছিল, নিজের জীবদ্দশায় অন্তত দোকানটি হারাতে হবে না। অথচ বর্ষার শেষে বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার মুখে বাসন্তীকে টেনে নিয়েছে কালাবগী গ্রামের সুতারখালী নদী।

অধর বাওয়ালি ভাঙনের কয়েক হাত দূরে এখন যখন-তখন পোড়ো এক ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। এ বয়সে নতুন জীবিকা শুরুর মানসিক শক্তি আর নেই। বাবার গল্প বলছিলেন, খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগীর পল্লিচিকিৎসক কৈলাস বাওয়ালি।

‘জঙ্গলে যাব। শহর ঠক মানুষে ভরা।’

সান্ত্বনা দেওয়ার সুরেই যেন নিজেকে শোনালেন, নদীর পাশে যাদের বাস, তাদের ভাবনা বারো মাস। তবে বাসন্তী মিষ্টান্নভান্ডার গেল এবার অসময়ের ভাঙনে শুধু মানুষের গাফিলতিতে। স্রোতের এক বিশাল দানব হয়ে উঠল নদী। গুম গুম শব্দে এগিয়ে এল গ্রামের বাজারের দিকে। যা পথে পেল, উপড়ে নিল, আছড়ে ফেলল। সেসব ভগ্নাংশ সঙ্গে নিয়ে রওনা হলো সাগরে। যেন নিজের কুকর্মের চিহ্ন রাখতে নারাজ নদী। কথা হচ্ছে, নির্মাণাধীন বাঁধ কেন ভাঙল?

সুতারখালীর স্থায়ী বাঁধ হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে। হস্তান্তরের আগেই এ ঘটনা। যেন বাঁধের বাঁধনের পরীক্ষক হয়েছিল সুতারখালী। উপকূলীয় জনপদে বাঁধ ভেঙে গ্রাম ভেসে যাওয়ার গল্প ষাটের দশক থেকে চলছে। ভাঙন হবে, সকালের ভাত রাঁধা উনুনের পেট দুপুরে ভরে উঠবে ঘোলা পানিতে, নৌকায় ভাসতে ভাসতে মানুষ জলবায়ু শরণার্থী হয়ে যাযাবরের মতো ঘুরবে, যেন এ সবই স্বাভাবিক। না হলে স্থায়ী বাঁধের দাবিতে নতুন নতুন প্রকল্প আসবে কোথা থেকে!

বাঁধের বাইরে থাকা মানুষ তো যেন নদীকূলে সঁপে দেওয়া প্রাণ। কালাবগীতে বাঁধের বাইরে আছে দুই হাজারের বেশি মানুষ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি ধারা ছিল, কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়েই মওকুফ হবে না রাজস্ব। উপকূলের ভাঙনও তেমনই এক চিরস্থায়ী ব্যবস্থা। স্থায়ী বাঁধ হওয়ার সময় ভাঙছে, সুরক্ষা না থাকলে ভাঙছে আর বাঁধ না হলে তো কথাই নেই। সেপ্টেম্বরের শেষে কালাবগীর বাঁধের এক শ মিটার ভেঙে সুতারখালী নদী প্রবেশ করে। আপাতত ঠেকা দিতে দেওয়া হয় সেই জিও ব্যাগ সেবা। দ্রুতই স্থায়ী বাঁধের কাজ শেষ না হলে এর পর থেকে ভাঙন আঙুলের কর গুনে গুনে বর্ষাকাল বা শুষ্ক মৌসুম হিসাব করে হানা দেবে না। এই ডিসেম্বরেও কাজ চলছে। সুন্দরবনঘেঁষা এ গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা শুধু জানেন অনিয়মের জন্য নির্মাণাধীন বাঁধ ভেঙেছে।

সুতারখালী নদী নিয়েছে কালাবগী বাজারের মসজিদের সামনের অংশ
ছবি: প্রথম আলো

দায়িত্বরতরা খবর পেয়ে পরিদর্শন করে আবার কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু কেন ভাঙল, এর কোনো জবাব নেই। এসব কথা বাঁধের ভেতরে থাকা মানুষের। বাঁধের বাইরে থাকা মানুষ তো যেন নদীকূলে সঁপে দেওয়া প্রাণ। কালাবগীতে বাঁধের বাইরে আছে দুই হাজারের বেশি মানুষ।

ভাঙন শুরুর মাসখানেক পর ঠাকুরবাড়ির ঘাট হয়ে খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগী রওনা হয়ে দেখা গেল বাজারের লালরঙা মসজিদটার আধখানা বারান্দা সলিলসমাধির জন্য ঝুলছে নদীর ওপর। এখন যেখান দিয়ে ট্রলার যাচ্ছে, দুই দিন আগে এখানেই ছিল বাসন্তী মিষ্টান্নভান্ডার ও এমন আরও অনেক জীবিকার সংস্থান। বর্ষীয়ান অধর বাওয়ালির দোকানের কথা বলতে বলতে কৈলাস বাওয়ালি জানালেন, একই গতি হয়েছে নিজের ওষুধের দোকানটারও।

সুন্দরবনঘেঁষা প্রত্যন্ত এ অঞ্চলে পল্লিচিকিৎসকেরাই মানুষের ভরসা। ওষুধের দোকান হারিয়ে এই চিকিৎসক এখন অন্যের ধার করা ঝুপড়িঘরে রোগী দেখেন। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র শশী ডাক্তারের মতো কৈলাস ডাক্তারেরও নিজ গ্রামকে বিদায় জানানোর গতি নেই। শশী ডাক্তারের চোখ মানুষ খুঁজে বেড়াত। বাস্তবের কৈলাস ডাক্তার একটু নিরাপদ জায়গা হত্যে দিয়ে খুঁজছেন থকথকে কাদার আস্তরণের ভেতর। অবাক মিল হচ্ছে, ঠাকুরবাড়ি ঘাট থেকে ট্রলারে উঠলে কালাবগী বাজারে যাওয়ার দুই ঘাট আগের ঘাটের নামও ‘শশী ডাক্তারের ঘাট’।

ভরা সন্ধ্যায় সুন্দরবনের কাছে পোনা ধরতে নেমেছেন নারী
ছবি: প্রথম আলো

এই কালাবগীর ঝুলনপাড়া নিয়ে মানুষের আগ্রহ বহুদিনের। জোয়ার থেকে বাঁচাতে গ্রামের মানুষ ঘরটা খুঁটির ওপর বসিয়েছেন। তখন থেকে নাম হয়েছে ঝুলনপাড়া।

মানুষের দুর্ভোগে তৈরি হওয়া ক্ষণস্থায়ী স্থাপত্যের নান্দনিক সৌন্দর্য আকর্ষণ করছে নাগরিক মন। তাই কালাবগী বললে শুধু ঝুলনপাড়ার গল্পই উঠে আসে। এবারের ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়েছে ‘গুরুরকোনা’ নামক জায়গা।

রামনগর, মঙ্গলবার বাজার, দোয়ানির গেট, শশী ডাক্তারের ঘাটের এক ঘাট পরই কালাবগী বাজার। সেখানে নামলেন অনেক মানুষ। তাঁদের বসনভূষণ ও গতিতে এখনো কিছুটা মন্দের ভালো নির্ভরতার ছাপ অবশিষ্ট। সবাই শহরের দিক থেকে ফিরছিলেন। ভাঙন হলে অন্তত অন্যজনের জমিতে গিয়ে প্রাণটা বাঁচানোর সুযোগ আছে তাঁদের।

মাঝি জানালেন, এরপরও এক গ্রাম আছে। সে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে না যায় লাইনের ট্রলার, না যান উন্নয়নকর্মী বা জনপ্রতিনিধিরা।

আমরা ভেবেছিলাম, কালাবগীতেই শেষ সুন্দরবনঘেঁষা এদিকের জনপদের গল্প। কিন্তু মাঝি জানালেন, এরপরও এক গ্রাম আছে। সে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে না যায় লাইনের ট্রলার, না যান উন্নয়নকর্মী বা জনপ্রতিনিধিরা। তবে তাঁকে বাড়তি ভাড়া দিলে নিয়ে যেতে পারেন।

দেড় বছর ধরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ‘ফকিরকোনা’ একটা আদর্শ নান্দনিক গ্রাম। পাশ দিয়ে সুতারখালী, পূর্ব ও দক্ষিণে সুন্দরবন, পশ্চিমে শিবসা ও সুন্দরবন। নদী আর সুন্দরবনের বুকের ভেতর দুলতে থাকা এ জনপদে নৌকা থেকে নামার কোনো ঘাট নেই।

এ গ্রামের লাবণি আর রণজিৎ সরদার দম্পতি অনাগত সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁদের আনন্দে ভাগ বসিয়েছে শিবসা, সুতারখালী আর ভদ্রা। প্রসবের সম্ভাব্য সময়ে এই দূরত্ব সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। এই ফকিরকোনা থেকে সবচেয়ে কাছের হাসপাতাল ভাটিতে চার ঘণ্টা, জোয়ারে পাঁচ ঘণ্টার দূরত্ব। তাই লাবণি সরদারকে সময়ের দুই মাস আগেই স্থানান্তর করা হয়েছে চালনা হাসপাতালে। তিনি ভাগ্যবানদের একজন। এই ব্যবস্থাপনা উপকূলের অধিকাংশ নারী, যাঁরা দুই বেলা পোনা ধরার শর্তে উনুনে আগুন দেন, তাঁদের জীবনে রাজবাড়িতে নিমন্ত্রণের সমান। তাঁদের গায়ে মাছের আঁশের বাসের সঙ্গে লেপ্টে থাকে অভাবের তীব্র গন্ধ। কাদার ভেতর পা টেনে টেনে কোনোমতে উঠতে হলো উঁচু স্থানে। এক কিলোমিটারের মতো বেঁচে যাওয়া উঁচু জায়গাটুকুই এখন গ্রামের একমাত্র বাসস্থানের জন্য অবশিষ্ট। যেন অবজ্ঞা করে সুতারখালী আর শিবসার ফেলে রাখা উচ্ছিষ্টাংশ। আম্পান ঝড়ে মূল কালাবগী থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে এ গ্রাম।

গোলপাতার এ ছাউনি আটটি পরিবারের বাথরুম
ছবি: প্রথম আলো

১৯৮৮ সালে বড় ঝড় হয়েছিল। তার পর থেকেই একটু একটু করে বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল এ গ্রাম। অর্থাৎ গ্রামটাও সময় দিয়েছিল ব্যবস্থা নেওয়ার। দু-একজন যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা পালিয়ে গেছেন ডাঙায়। আর যাঁদের সে গতি নেই, তাঁরা পড়ে পড়ে মার খান জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের। এটুকু ডুবলে মানুষগুলোও ডুববে। ফকিরকোনার সেই অবশিষ্টাংশের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আছিয়া বেগম। তেমন হলে কোথায় যাবেন জিজ্ঞেস করলে বললেন, ‘জঙ্গলে যাব। শহর ঠক মানুষে ভরা। কয়েক দিন আগে এক ছেলে দাকোপে গেছিল ভ্যান চালাতে। জমানো সব টাকায় কেনা সে ভ্যান এক মাসের মাথায় চুরি হয়েছে। মন খারাপ করে ছেলেটা এখন বাড়ি বসে আছে।’ ৫৫ বছর বয়সী আছিয়া খাতুনের অভিজ্ঞতা বলে, শহরে গেলে তাঁদের ভিখিরি হতে হবে। এর চেয়ে জঙ্গলই ভালো। কেননা, এই তো দুহাত দূরের ওই বনটাই তাঁদের জন্ম থেকে চেনা।

উপায়হীন মানুষ সুন্দরবন থেকে কেটে আনেন দুটো কাঠ বা কিছু গোলপাতা
ছবি: প্রথম আলো

ভিখিরি হতে ভয় পাওয়া এসব মানুষ কিন্তু সুন্দরবনের নির্ভীক বনজীবী। ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে গভীর সমুদ্রে যাওয়া এ মানুষগুলোর তিন হাতের নৌকা দোলে ঢেউয়ে। কাঁকড়া ধরতে দোন ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা সময়ে পিঠের চামড়া পুড়ে চৌচির হতে চায় ফাটা মাটির মতো। থাকেন এমন ঘরে, যা বাতাস আসার আগেই দুলতে থাকে গাছের ডালের মতো। জোয়ারে ঘরের ভেতর উঠে আসে সাপ।

২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোয় একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘দাকোপের ১১০ গ্রামে ১১ বছরেও বিদ্যুৎ মেলেনি’। এ প্রতিবেদনের বয়স আট বছর। এরপর আট বছরেও বিদ্যুৎ পায়নি কালাবগীর ফকিরকোনার মানুষ। জোয়ারে দুই বেলা ভেসে যাওয়া এ গ্রামের বসতিতে আছে ১৭০টির মতো পরিবারের ১ হাজার ২০০ মানুষ।

সুতারখালী আর শিবসা নদীর বেষ্টনীতে আটকে থাকা সামান্য একটু এ জনপদ এখন সিন্ধুতে বিন্দুর এক দাগ শুধু। এখানে আসার পথে ট্রলার থেকে চোখ আটকাবে দুই ফুট বাই চার ফুট গোলপাতার উঁচু টংঘরে। শিবসাঘেঁষা ঘর সালমা বেগম আর আসাদুল গাজী দম্পতির। তাঁদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে সালমা জানালেন, টংয়ের ঘর নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার বাথরুম। সেখানে দরজা দূরের কথা, পর্দাও নেই। নারীরা গেলে শাড়ির আঁচল ঝুলিয়ে রাখেন উপস্থিতি জানাতে।

যখন-তখন ডুবতে বসা এই ফকিরকোনায় কোনো উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না বা আদৌ তা কতটা সম্ভব, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল সুতারখালীর চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকিরের কাছে। তিনি বললেন, ‘ভাঙনে ফকিরকোনার এখন যে অবস্থা, তাতে আসলে কোনো স্থাপনা সম্ভব না। মূল কালাবগীতে গুচ্ছগ্রাম তৈরির প্রকল্প পাস হয়েছে। কাজ সম্পন্ন হলে ফকিরকোনার বাসিন্দাদের স্থানান্তর করা হবে।’

সুতারখালী নদী আর শিবসা নদীর বেষ্টনীতে আটকে থাকা সামান্য একটু এ জনপদ এখন সিন্ধুতে বিন্দুর এক দাগ।

হঠাৎ যদি ফকিরকোনায় ভাঙন শুরু হয়, তাহলে কী করবেন, জিজ্ঞেস করলে ৯ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার নিমাই রায় জানালেন, দুটো ট্রলার আছে, দ্রুত কালাবগী বন বিভাগের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। আর ফকিরকোনায় একটি রাস্তা বানানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু ফকিরকোনার বাসিন্দারা বলছেন, প্রতিটি নির্বাচনের আগে শুধু তাঁরা আশ্বাস পান। এরপর আর কারও সঙ্গে দেখা হয় না। প্রায় ডুবন্ত এ জায়গায় আদৌ নতুন কিছু সম্ভব কি না, জানতে দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিন্টু বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে বিফল হতে হয়েছে। মুঠোফোনে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকেরা যখন-তখন ফোন করে নানা রকম তথ্য চান। এসব আচরণ ঠিক না। আমরা সব তথ্য তৈরি করে বসে থাকি? আপনাদের স্থানীয় সাংবাদিক নেই? তাহলে ঢাকা থেকে ফোন করেছেন কেন?’ সুতরাং দায়িত্বরত এই কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

নদী আর সুন্দরবনের বেষ্টনীতে আটকে থাকা ফকিরকোনার মানুষ শুধু অপেক্ষা করে
ছবি: প্রথম আলো

তথ্য পাওয়া, না-পাওয়া বা সংবাদ হওয়া, না-হওয়ার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ অপেক্ষা করে না।

ফকিরকোনা প্রায় বনের ভেতরেই। শিবসা আর সুতারখালীর সংযোগমুখে দোন ফেলে (কাঁকড়া ধরার দড়ি) বনের দিকে বসে ছিলেন বৃদ্ধ নির্বাণ সরদার। তিনি জানালেন, বন বিভাগ কড়াকড়ি করায় আগের মতো যখন-তখন বনে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বাড়ির পাশেই ছিপ বা দোন ফেলে বসে থাকেন। উপায় না পেয়ে দু-একজন হয়তো বনে যান সুযোগ বুঝে। গোলপাতা বা হয়তো দুটো মরা ডাল কেটে আনেন। কিন্তু সেটা তো অবৈধ বললে নির্বাণ সরদার উত্তর দিলেন, ‘হাত-পা বাঁধা মানুষের সাঁতার কেটে বাঁচতে হলে সে কী করবে?’

‘হাত-পা বাঁধা মানুষের সাঁতার কেটে বাঁচতে হলে সে কী করবে?’

সুতারখালীকে দুই বেলা অভিশাপ দেওয়া নির্বাণ সরদার বা আছিয়া বেগমদের মতো উপায়ান্তরহীন মানুষকে যেটুকু বর দেওয়ার, তা আবার এ নদী আর বনই দেয়। এটুকু সম্বল করেই বেঁচে থাকেন তাঁরা। জনপ্রতিনিধি বা সমাজকর্মীদের কাছ থেকে সহায়তা পান না। এর প্রমাণ ২০২০ সালে আম্পান ঝড়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হওয়া সুতারখালীর কালাবগীর ফকিরকোনায় দেড় বছরে কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বৃষ্টির জন্য তারা চাতকের মতো তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।

অধিকাংশের বাড়িতে পানি ধরে রাখার বড় ড্রাম নেই। চালনা থেকে আনা ২৫ থেকে ৩০ লিটারের ড্রামের পানি কিনে খেতে হয়, যার দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এ গ্রামের মানুষের এক দিনের উপার্জনের সমান এ মূল্য। নোনাপানি ব্যবহার করে করে এ অঞ্চলের নারীদের জরায়ুর অসুখসহ বাড়ছে চামড়ার রোগ। কৈলাস বাওয়ালি বলছিলেন, তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি রোগী আসে পানিবাহিত অসুখ নিয়ে। এ তো মূল কালাবগীর পল্লিচিকিৎসকদের কথা। আর ফকিরকোনায় চিকিৎসক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আছিয়া বেগম পাল্টা জানতে চেয়েছিলেন, ‘এখানে যে একটা গ্রাম আছে, সে গ্রামে কিছু মানুষ থাকে, সরকার কি তা জানে? মনে হয় না জানে।’

এই বাঁধটুকুই গ্রামের অস্তিত্ব। পুরো গ্রাম নদীতে
ছবি: প্রথম আলো

একসময় এসব অঞ্চল সুন্দরবনেরই অংশ ছিল। দাকোপের এদিকের অঞ্চলে জঙ্গল কেটে বসতি শুরু হয়েছে বাংলা ১২৯৯ সালের দিকে। সাতক্ষীরার আশাশুনি থেকে কানাই ঢালির মতো ২০-২৫ জন এসেছিলেন আবাদ কেটে বসতি করতে। সোয়া এক শ বছর পর কানাই ঢালির চতুর্থ প্রজন্মের বসবাস এখন কালাবগীতে। ফকিরকোনার একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘আমাদের স্কুল’-এর একমাত্র শিক্ষক আম্বিয়া বলছিলেন, এই সেদিনের কথা, তাঁদের গ্রামে গাজীর গীত শুনতে মানুষজন ঘর থেকে আসন পিঁড়ি নিয়ে আসত আয়োজন করে। এত মানুষের একসঙ্গে গান শোনার, যাত্রাপালা দেখার জায়গা ছিল তখন। পাশেই ছিল সুপেয় পানির পুকুর। ফসল ফলত। নোনাপানির নদ-নদীর ভেতরও অপরাজেয় সেসব জলাধার মানুষের মিঠাপানির জোগান দিয়েছে।

সেসব জায়গা এখন গ্রামবাসী আঙুল তুলে দেখালে শিবসা-সুতারখালীর থই থই পানি ছাড়া কিছু দেখা যায় না।

এমন থই থই পানির ভেতরও গ্রাম ছেড়ে আসা মানুষ তাদের স্মৃতিচারণা করতে যায়। চার বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে মো. মফিজুল ইসলাম এক যুগ পর গত সপ্তাহে বাড়ি গিয়েছিলেন। পৈতৃক ভিটা চেনাতে ছেলেকে যা-ই দেখান, শিশু নুসাইদ বলছিল, পানি, পানি। ওর চোখে এখন যা নদী, মফিজুলের স্মৃতিতে সে জায়গায় বড় উঠান, মায়ের রান্নাঘর, বসতঘর লাগোয়া গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা একটা লাল গরু। তিনি স্পষ্ট দেখছিলেন সব কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, এসব কিছুই আর এখন বাস্তবে নেই।

সুন্দরবনঘেঁষা ঝুঁকিপূর্ণ ফকিরকোনার দুই পাশে শিবসা আর সুতারখালী
ছবি: ইন্টারনেট থেকে

মফিজুল ইসলামদের বাড়ি ছিল কালাবগীর দুয়ানিরঘাটের কাছে। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় সব হারিয়ে পুরো পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল বাগেরহাটের ফকিরহাটের শুভদিয়া চরে। মফিজুল বলছিলেন, ‘কার কাছে কোথায় যাব? চেনা জায়গা অপরিচিত হয়ে গেলে খুব কষ্ট হয়।’

কালাবগীর ফকিরকোনার বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনায় অতীতের গীত বা যাত্রাপালার আয়োজন কিংবা সব হারানো মানুষের স্মৃতির পরীক্ষার গল্প বিলাসিতা। এ গ্রামে এই মুহূর্তে টিকে থাকা মানুষের জীবনের সুরই করুণভাবে বেজে চলেছে সুরের সপ্তম স্তরে। অথচ সে সুর ভদ্রা নদী অতিক্রম করে নগরে পৌঁছায় না কিছুতেই।