‘এত বছর পর পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করছে, স্বামী গুম হয়েছে কি না’

কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা আজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সমাবেশে যোগ দিয়ে স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।
ছবি: দীপু মালাকার

কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বাতেন তিন বছর ধরে বাড়ি ফেরেন না। র‌্যাব–৪ তাঁকে তুলে নিয়েছিল বলে পরিবারের অভিযোগ। আজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক প্রতিবাদ সমাবেশে তাঁর স্ত্রী নাসিমা আক্তার বলেন, স্বামীর খোঁজে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তিন বছর পর এখন পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা করছে, ইসমাইল সত্যিই গুম হয়েছেন কি না।

২০১৯ সালের ১৯ জুন ইসমাইল হোসেন নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে নাসিমা আক্তার সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কী আচরণের মুখোমুখি হয়েছেন, তার বিবরণ দেন। নতুন করে পুলিশি তৎপরতার কী কারণ, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

নাসিমা আক্তার বলেন, ‘কিসের পুলিশ? আমি থানায় গেছি, পুলিশ আমাকে থানা থেকে বের করে দিয়েছে। পুলিশের ডিসি আমার চিঠিটা একবার পড়ল না। বলে র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আপনি র‌্যাবের কাছে যান। পুলিশ এখন তিন বছর পর এসে জিজ্ঞেস করে আমার স্বামী আসলে গুম হয়েছে, নাকি কোথাও চলে গেছে। আমাদের কষ্ট লাগে, ঘেন্না আসে এখন। মন্ত্রীরা আরামে বসে থাকে, আমাদের বিরুদ্ধে যখন কথা বলে, হেলেদুলে বলে, “আরে না। বাংলাদেশে কখনো গুম হয় না। উনারা ঋণের দায়ে চলে গেছে, বিয়ে করেছে।’ এটা কতটা লজ্জার! আমার মনে হয় না সমাজে শ্বাস নিই। আমাদের এখন মেরে ফেলেন। তারা আমাদের চোখের পানি নিয়ে হোলি খেলে। উপহাস করে। আমার ঘরে কোনো উৎসব হয় না। আমার বাচ্চারা কখনো হাসে না।’

স্বজনের খোঁজ চেয়ে পুলিশের কাছে গেলে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ
ছবি: দীপু মালাকার

স্বামীর সন্ধান চেয়ে এই নারী বলেন, ‘বলেন কোথায় রেখেছেন। লাশটা দেন। আমরা কি কোনো দিন একটা মিলাদ পড়তে পারব?’

সম্প্রতি যাঁদের বাড়িতে পুলিশ গেছে বা যাঁদের থানায় যেতে হয়েছে বা পুলিশের লিখে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করার জন্য চাপের মুখে পড়তে হয়েছে, তাঁরাই মূলত আজ শনিবার মায়ের ডাকের সমাবেশে অংশ নেন। এই সমাবেশে ভুক্তভোগী সব পরিবার ও সাংবাদিক হাজির হওয়ার আগেই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া শাখায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা হাজির হন। তাঁরা ভুক্তভোগীদের বক্তব্য রেকর্ড করেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নও করেন। মায়ের ডাকের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও তাঁদের স্বাগত জানান।

মায়ের ডাকের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম বলেন, ‘তদন্ত করলে সাধুবাদ জানাই। আপনারা জাতিসংঘকে কাগজপত্র পাঠাতে চান বলেছেন। আমরা আমাদের স্বার্থেই সহযোগিতা করব। কিন্তু আপনারা এই যে হাফ উইডোদের (প্রায় বিধবা) কখনো দিনে কখনো রাতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। দুই ঘণ্টা আটকে রেখেছেন। তাঁরা ভীতির মধ্যে আছেন। তাঁদের ফিরে পেতে যা যা করতে হয়, মানবিকতার সঙ্গে করেন।’

‘মন্ত্রীরা আরামে বসে থাকে, আমাদের বিরুদ্ধে যখন কথা বলে, হেলেদুলে বলে, “আরে না। বাংলাদেশে কখনো গুম হয় না। উনারা ঋণের দায়ে চলে গেছে, বিয়ে করেছে।’ এটা কতটা লজ্জার! আমার মনে হয় না সমাজে শ্বাস নিই। আমাদের এখন মেরে ফেলেন। তারা আমাদের চোখের পানি নিয়ে হোলি খেলে। উপহাস করে। আমার ঘরে কোনো উৎসব হয় না। আমার বাচ্চারা কখনো হাসে না।’
‘গুম’–এর শিকার পরিবারগুলো প্রিয়জনকে খুঁজে পেতে প্রয়োজনে জাতিসংঘের তদন্ত চান বলে জানিয়েছেন সমাবেশের আয়োজকেরা
ছবি: দীপু মালাকার

আফরোজা আরও বলেন, পুলিশ এখন বলার চেষ্টা করছে যে জিডির কপিতে তথ্য গোপন করা হয়েছে। স্বজনেরা যখন গুম হন, তখন পুলিশ মামলা বা থানায় সাধারণ ডায়েরি নিতে চায়নি। তাঁর ভাই সাজেদুল ইসলাম গুম হওয়ার পর তাঁরা ভাটারা থানায় গেলে পুলিশ বলেছে তেজগাঁওয়ে যেতে, তেজগাঁওয়ে গেলে বলেছে উত্তরায় যেতে হবে। ছয়–সাতজনের সামনে থেকে র‌্যাব ধরে নিয়ে গেছে এই কথা বললে আর জিডি করা যায়নি। বলা হয়েছে, বাসায় ফেরেনি, খুঁজে পাওয়া যায়নি—এভাবে লিখতে। এসব কথা আগেও অজস্রবার বলা হয়েছে। এখন নতুন করে ধানাইপানাই করা হচ্ছে যে তথ্য গোপন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলো একটা স্বাধীন নিরপেক্ষ, বিচারবিভাগীয় তদন্ত চায়। জাতিসংঘের তদন্ত কমিটিকে আসতে দেওয়ারও দাবি করে তারা।

কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ বংশাল থানা ছাত্রদল সভাপতি পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, তিনি এখন সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকেন। কয়েক দিন আগে পুলিশ স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়ে বংশালে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যায়। তাঁর শাশুড়ির ফোন থেকে তাঁকে ফোন দেয় এবং দেখা করতে বলে। তিনি জানান, ঢাকায় ফিরে তিনি পুলিশকে খবর দেবেন। তাঁদের যা যা তথ্য লাগে, সবই জানাবেন। তখন ওই পুলিশ সদস্য তাঁকে একটি রেস্তোরাঁয় দেখা করতে বলেন।

এমনকি ওই পুলিশ সদস্যরা পারভেজ হোসেনের মাকে বলেছেন, ফারজানা জানেন তাঁর স্বামী কোথায়। তিনিই লুকিয়ে রেখেছেন। ফারজানার প্রশ্ন, তিনি লুকিয়ে রাখলে পুলিশ কেন খুঁজে বের করতে পারছে না?

এত দিন পর পুলিশ এখন আবার নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে বলে অভিযোগ করেছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা
ছবি: দীপু মালাকার

লক্ষ্মীপুর থেকে হারিয়ে যাওয়া বিএনপির সদস্য আলমগীর মোল্লার বাবা শাহজাহান মোল্লা বলেন, ১০ জানুয়ারি থেকে তাঁকে কয়েকবার থানায় যেতে হয়েছে। তাঁর ছেলের সঙ্গে কী ঘটেছিল, সেই বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছে পুলিশ। বেশ কয়েকটি অনুলিপি তিনি দেখেছেন। কিন্তু তিনি যে কাগজে স্বাক্ষর করেছেন, তার একটি অনুলিপি চাইলেও পুলিশ দেয়নি। একই জেলার বাসিন্দা ফরিদ আহমেদের বোন শিল্পী বলেন, তাঁদের বাসায় পুলিশ কয়েকবার গেছে। কাগজপত্রে তাঁর, স্বামীর ও মায়ের সই নিয়েছে।

ঢাকা থেকে গুম হওয়া আবদুল কাদের মাসুমদের বাসায় পুলিশ তিনবার গেছে। প্রতিবারই একই কথা জিজ্ঞাসা করেছে তারা।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলো ছাড়াও সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি।