এফ আর টাওয়ারে নকশা জালিয়াতি, পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

এফ আর টাওয়ারে আগুন। ফাইল ছবি
এফ আর টাওয়ারে আগুন। ফাইল ছবি

রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ার নির্মাণে ইমারত বিধিমালা লঙ্ঘন এবং নকশা জালিয়াতির মাধ্যমে ১৮ তলা পর্যন্ত বাড়ানোর অভিযোগে করা মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে জমির মালিক এস এম এইচ আই ফারুক, রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুলসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার মামলার অভিযোগপত্র দুদকের ঢাকা–১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিক। দুই–এক দিনের মধ্যেই সেটা আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য।

অভিযোগপত্রে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ূন খাদেম, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান ও সাবেক অথরাইজড অফিসার সৈয়দ মকবুল আহমেদকে আসামি করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ইমারত বিধিমালা লঙ্ঘন এবং নকশা জালিয়াতির মাধ্যমে ১৮ তলাবিশিষ্ট এফ আর টাওয়ার নির্মাণ করেন। ১৯৯০ সালে ১৫ তলা ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকের অনুমোদন পান এস এম এইচ আই ফারুক। পরে ১৯৯৬ সালে ১৮ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন চেয়ে সংশোধিত নকশা অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন তিনি। সংশোধিত নকশা ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী না হওয়া এবং প্রস্তাবিত ভবনের উচ্চতা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধ অনুযায়ী অনুমোদনযোগ্য নয় বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। এর এক মাসের মধ্যেই সংশোধিত ও নকশা অনুমোদন করা হয়। এ কাজে অবৈধ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

পরে ১৮ তলা ভবন নির্মাণের জন্য জমির মালিক চুক্তিবদ্ধ হন আবাসন প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রুপের সঙ্গে। রূপায়ন ওই জায়গায় অবৈধ নকশার ভিত্তিতেই ১৮ তলা ভবন নির্মাণ করে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে ভবনের দুই পাশে যে পরিমাণ জায়গা রাখার কথা তা–ও রাখা হয়নি। পার্কিয়ের জায়গার ক্ষেত্রেও রাখা হয়েছে প্রায় নির্দিষ্ট পরিমাণের এক–তৃতীয়াংশ জায়গা। আবাসিক ভবন হিসেবে অনুমোদন নেওয়া হলেও পুরো ভবনটি ব্যবহার হয়েছে বাণিজ্যিক হিসেবে।

এজাহারে আরও বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করায় অগ্নিকাণ্ডে জনসাধারণের জানমালের ক্ষতি হয়েছে।

অভিযোগপত্রে আসা পাঁচজনই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। চলতি বছরের ২৫ জুন উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে মামলাটি করেন। ওই দিন দুদকের করা আরেকটি মামলায় এস এম এইচ আই ফারুক, লিয়াকত আলী খান মুকুল, এফ আর টাওয়ার ওনার্স সোসাইটির সভাপতি ও কাসেম ড্রাইসেলের এমডি তাসভীর উল ইসলামসহ ২০ জনকে আসামি করা হয়। এই মামলায় ভুয়া ছাড়পত্রের মাধ্যমে এফ আর টাওয়ারকে ১৯ থেকে বাড়িয়ে ২৩ তলা করা, ওপরের ফ্লোরগুলো বন্ধক দেওয়া ও বিক্রি করার অভিযোগ আনা হয়। মামলাটির তদন্তও শেষ পর্যায়ে।
কামাল আতাতুর্ক অ‌্যাভিনিউয়ে ওই ভবনের জমির মূল মালিক ছিলেন প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক। অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ভবনটি নির্মাণ করে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেড। সে কারণে সংক্ষেপে ভবনের নাম হয় এফ আর টাওয়ার।
চলতি বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগে। এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৭ জন মারা যান। তাঁদের মধ্যে কেউ ভবন থেকে পড়ে আবার কেউ আগুনে পুড়ে মারা যান। আহত হন অনেকে। এর পরপরই ভবনটির নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে।

আগুন লাগার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। তিন আসামি হলেন এফ আর টাওয়ারের জমির মালিক এস এম এইচ আই ফারুক, ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল এবং এফ আর টাওয়ারের বর্ধিত অংশের মালিক বিএনপির নেতা তাসভীর উল ইসলাম।

এফ আর টাওয়ারে অনিয়মের ঘটনায় গঠিত গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি দায়ী করেছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে। গত ২২ মে গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত কমিটির ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ওই দিন তিনি বলেন, এফ আর টাওয়ারের নকশা অনুমোদনে বিধি লঙ্ঘন এবং নির্মাণের ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। শুধু তা-ই নয়, অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ভবনটির ১৯ থেকে ২৩তম তলা। আর এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. হুমায়ূন খাদেমসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। মন্ত্রী আরও বলেন, অবৈধভাবে নির্মিত ১৯ থেকে ২৩তম তলা পর্যন্ত ভেঙে ফেলা হবে। এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা করা হবে। আর ১৬ থেকে ১৮তম তলা পর্যন্ত অনুমোদনের ক্ষেত্রে আইনি ত্রুটি থাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে ভবন নির্মাণের অনিয়ম ও ত্রুটিতে যেসব ব্যক্তিকে দায়ী করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ূন খাদেম, রাজউকের সাবেক সদস্য ডি এম ব্যাপারী, রাজউকের সাবেক নগর-পরিকল্পনাবিদ জাকির হোসেন, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান, সাবেক অথরাইজড অফিসার-২ সৈয়দ মকবুল আহমেদ, সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ উল্লাহ, জমির মূল মালিক এস এম এইচ আই ফারুক, সাবেক অথরাইজড অফিসার এ টি এম কামরুজ্জামান, সাবেক অথরাইজড অফিসার নাজমুল হুদা, সাবেক সহকারী অথরাইজড অফিসার মো. বদরুজ্জামান মিয়া, সাবেক সহকারী অথরাইজড অফিসার বশির উদ্দিন খান, ইমারত পরিদর্শক ইমরুল কবির, ইমারত পরিদর্শক মো. শওকত আলী, উচ্চমান সহকারী মুহাম্মদ আবদুর রহমান, উচ্চমান সহকারী (সাময়িক বরখাস্ত) মো. সফিউল্লাহ, নিম্নমান সহকারী মো. মজিবুর রহমান (সাময়িক বরখাস্ত), সাবেক তত্ত্বাবধায়ক জাহানারা বেগম, বিষয় পরিদর্শক মো. মেহেদুজ্জামান, সহকারী পরিচালক (এখন সাবেক) শাহ মো. সদরুল আলম, উপপরিচালক মুহাম্মদ শওকত আলী (প্রেষণ), পরিচালক শামসুল আলম (প্রেষণ), সদস্য (এস্টেট) রাজউল করিম তরফদার, তত্ত্বাবধায়ক মোফাজ্জল হোসেন, তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো. এমদাদ আলী বিশ্বাস (মৃত), পরিচালক আবদুল্লাহ আল বাকি, সদস্য আ ই ম গোলাম কিবরিয়া, অফিস সহকারী মো. এনামুল হক, তৎকালীন ইমারত পরিদর্শক নজরুল ইসলাম প্রমুখ।