এবার সত্যি ‘বিদায়, রানা’

কাজী আনোয়ার হোসেন (১৯৩৬–২০২২)

‘…আমি তো গম্ভীর গম্ভীর প্রবন্ধ আর বই নিয়ে কাটিয়েছি, তাই সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার ব্যবধান থেকেই গেছে। নবাব ওদিকে গালগল্প আর রহস্য-রোমাঞ্চ লিখে বাজার মাত করেছে। ওর নামে কিছু লিখলে এখন ওর ভক্তরা আমার সম্পর্কে বলে, “দেখেছ। মহিলা কী শয়তান!”

‘উনসত্তর সালে কারমাইকেল কলেজে পড়াতে গেছি, এক ছাত্র ভক্তিভরে পরিচয় করতে এল। বলে কি, “আপনি যে মাসুদ রানার বোন, সেটা আমি আগে জানতাম না। ওনাকে আমরা খু-ব শ্রদ্ধা করি।” পিত্তি জ্বলে গেল। বললাম, “আমি মাসুদ রানার বোন হতে যাব কেন, ও-ই আমার ছোট ভাই।” ছেলেটি আমার কথার ঝাঁজে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেষে বলল, “ও! উনি বুঝি আপনার ছোট!” বোঝা গেল নবাব মিয়া স্বাধীনভাবে লেখালেখি করে অ্যায়সা জমিয়েছে যে মানুষের মনে আমার চেয়ে জ্যেষ্ঠতা দখল করে বসে আছে! আমার আর কিছুই করার নেই।’

ছোট ভাই নবাব, মানে কাজী আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে এ কথাগুলো লিখেছিলেন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, গবেষক, সংগীতশিল্পী ও অধ্যাপক ড. সন্‌জীদা খাতুন (অতীত দিনের স্মৃতি, পৃ. ৬৯-৭০, প্রজাপতি প্রকাশন, ঢাকা, ১৯৯৩)। এত অল্প কথায় বাংলা রহস্যসাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষের জাদুকরি সাফল্যকে বোধ হয় আর কেউই তুলে ধরতে পারেননি। আর এ দুই ভাই-বোন হলেন বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ, দাবাড়ু, সাহিত্যিক ও অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের দুই সন্তান। তাঁদের মা ছিলেন সাজেদা খাতুন।

পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আড়াল থেকে ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’ লেখানোর প্রথা শুরু করেন তিনি। তবে আড়াল থেকে সবচেয়ে বেশি ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’র লেখক শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে এ নিয়ে তিক্ততা তৈরি হয়, যা গড়ায় কপিরাইট মামলায়।

বাংলা সাহিত্যজগতে প্রথম বাঙালি গুপ্তচর চরিত্র ‘মাসুদ রানা’ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেই চিরকালের মতো এক কিংবদন্তিতুল্য হয়ে যান। নিজের গড়া সেবা প্রেস থেকেই বই ছেপে প্রকাশ করা শুরু করেছিলেন, যা পরে সেবা প্রকাশনীতে রূপ নেয়। ছোটদের জন্য ‘কুয়াশা’ সিরিজের বই প্রথম ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বন্ধু মাহবুব আমিনের কাছ থেকে পাওয়া ‘জেমস বন্ড’ সিরিজের ডক্টর নো পড়ার পর ওই ধরনের গুপ্তচর কাহিনি লেখার ইচ্ছা চেপে বসে। মোটরসাইকেলে চেপে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও কাপ্তাই ঘুরে এসে ‘মাসুদ রানা’ লেখায় হাত দেওয়া। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভক্ত হওয়াতেই এমনটি করেছিলেন। ফল হলো, ধ্বংস পাহাড় উপন্যাস, যা ১৯৬৬ সালের মে মাসে প্রকাশিত হওয়ার পর চারদিকে, বিশেষত তরুণসমাজের মধ্যে ভীষণ সাড়া পড়ে গিয়েছিল। আর সিরিজের দ্বিতীয় বই ভারতনাট্যম [ভরতনাট্যম নয়] যেন তাঁর জন্য দিগন্ত খুলে দেয়। পাঠকের চাহিদা মেটাতে তিনি বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে ‘মাসুদ রানা’ লেখা শুরু করলেন।

স্বর্ণমৃগ, পিশাচ দ্বীপ; কাজী আনোয়ার হোসেন

রক্ষণশীল সমাজে ‘মাসুদ রানা’ একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল। রহস্য-রোমাঞ্চ-অভিযানের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের কিছু উপাদানের মিশেল সহ্য করা কঠিনই ছিল কথিত সমাজপতি ও অভিভাবক শ্রেণির জন্য। তাই নিন্দা-সমালোচনা, মামলার পাশাপাশি সাময়িকভাবে বই নিষিদ্ধ হওয়ার মুখে পড়ে। তবে পাঠকদের বিপুল সমর্থন ও উৎসাহ আর নিজের তারুণ্যের অনমনীয় জেদ তাঁকে উতরে দেয় সেই সময়ের বাধাগুলো থেকে। মৌলিক গল্প বা উপন্যাস লেখার ক্ষমতা নেই বলে চুরি করছেন—এমন নিন্দাবাদও কম সইতে হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের এই ছাত্রকে। অথচ গল্পসংকলন পঞ্চ রোমাঞ্চ ও ছায়া অরণ্য আর উপন্যাস তিনটি উপন্যাসিকা পড়ে বোঝা কঠিনই ছিল যে বিদেশি কাহিনির ছায়া আছে ওতে। দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক ও প্রখ্যাত কবি আহসান হাবীব নিরন্তর সমর্থন দিয়েছেন এই লেখালেখিতে।

শুধু ‘মাসুদ রানা’ আর ‘কুয়াশা’ নয়, সেবা প্রকাশনী উপহার দিতে থাকে বিভিন্ন বিশ্ব ক্ল্যাসিক বইয়ের সহজ অনুবাদ ও রূপান্তর। রহস্যপত্রিকা ১৯৮৪ সালের নভেম্বর থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত বের হতে শুরু করে। সেবা প্রকাশনীর নিজস্ব ভাষারীতিও গড়ে ওঠে। নিউজপ্রিন্টে ছেপে পেপারব্যাকে মুড়ে সস্তায় বই পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে পাঠক তৈরিতে নীরবে এক বিরাট কাজ করে ফেলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। বাংলা প্রকাশনার একটি নতুন মডেল বা আদলও দাঁড় করিয়ে ফেলেন—নগদ বেচাকেনা। সেবার লেখকদের নিয়মিত রয়্যালিটি প্রদানের প্রথাও চালু হয় প্রায় শুরু থেকে। চালু হয় পাণ্ডুলিপি সম্পাদনারও রীতি। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আড়াল থেকে ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’ লেখানোর প্রথা শুরু করেন তিনি। তবে আড়াল থেকে সবচেয়ে বেশি ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’র লেখক শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে এ নিয়ে তিক্ততা তৈরি হয়, যা গড়ায় কপিরাইট মামলায়।

একাধারে লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক কাজী আনোয়ার হোসেনের ভেতর অনেক আগেই হারিয়ে যান গায়ক আনোয়ার, যিনি সুতরাং সিনেমায় আবদুল আলীমের সঙ্গে গেয়েছিলেন ‘এই যে আকাশ, এই যে বাতাস’ গানটি সেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি। তবে রেডিওতে গান গাইতে গিয়ে পরিচয় ও পছন্দ হওয়া গায়িকা ফরিদা ইয়াসমিনকেই জীবনসঙ্গিনী করেছিলেন। তাঁদের পাঁচ দশকের বেশি সময়ের দাম্পত্যের অবসান ঘটে ২০১৫ সালের আগস্টে, ফরিদা ইয়াসমিনের প্রয়াণে। তাঁদের তিন সন্তান—এক মেয়ে সোনী, দুই ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন (বড়) ও কাজী মায়মূর হোসেন (ছোট)। অবসরে মাছ ধরা আর গিটার বাজানোটা বহুদিন ধরে রেখেছিলেন। করেছেন ধ্যান চর্চা। একে একে এগুলো বাদ পড়লেও গান শোনা বাদ যায়নি। আর ‘মাসুদ রানা’র বইও বন্ধ হয়নি। তবে রানার স্রষ্টা নিজে বিদায় নিলেন গতকাল বুধবার। রানাভক্তরা এখন তিন খণ্ডে লেখা (সিরিজের ৫৬, ৫৭ ও ৫৮তম বই) বিদায় রানার কথা মনে করতেই পারেন।