এলপিজির দাম কমাতে সরকারিভাবে আমদানির চিন্তা

মন্ত্রণালয় বলছে, কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো দামে গ্যাস বিক্রি করে। সরকারিভাবে আমদানি হলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

এলপিজি
ফাইল ছবি

ভোক্তাদের সাশ্রয়ী দামে সরবরাহের লক্ষ্যে সরকারিভাবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানির চিন্তা করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এ জন্য কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রে একটি এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছে। এখান থেকে বছরে ১০ থেকে ১২ লাখ টন এলপিজি সরবরাহ করা যাবে।

বিপিসি বলছে, বেসরকারি খাতে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলপিজি আমদানি হচ্ছে। দুই থেকে তিন হাজার টনের জাহাজে এলপিজি আনতে প্রতি টনে খরচ পড়ে ১০০ থেকে ১১০ ডলার। সেখানে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টনের জাহাজে আমদানি করলে খরচ পড়বে ৬৫ থেকে ৭০ ডলার। প্রতি টনে ৩৫ থেকে ৪০ ডলার সাশ্রয় হবে। তাতে দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সাড়ে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম কমতে পারে প্রায় ৩০০ টাকা।

টার্মিনাল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে জাপানের একটি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করতে চায় বিপিসি। এর খসড়া যাচাই করছেন বিপিসির আইনজীবীরা। এটি অনুমোদনের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর মাতারবাড়ী এলাকায় নির্মিত হবে রেফ্রিজারেটেড মাদার টার্মিনাল। এ টার্মিনালের জেটি থেকে বেসরকারি কোম্পানির কাছে এলপিজি বিক্রি করা হবে।

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, এলপিজি আমদানির জন্য টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। খসড়াটি সরকার অনুমোদন দিলেই জাপানি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হবে।

বিপিসির তথ্যমতে, দেশে সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তির ১৯টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জেটির মাধ্যমে আমদানির সুবিধা আছে, আর আমদানি ছাড়াই এলপিজি বিক্রি করছে ৭টি কোম্পানি। নতুন ৫ থেকে ৬টি প্রতিষ্ঠান বাজারে আসার অপেক্ষায় আছে। বেসরকারি খাতে জেটি আছে মোংলা ও সীতাকুণ্ডে। নদীর গভীরতা কম হওয়ায় ছোট জাহাজে আমদানি করা হয়। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। প্রস্তাবিত টার্মিনালে ৪০ হাজার টন ধারণক্ষমতার জাহাজ নোঙর করা যাবে। টার্মিনালে ৫০ হাজার টন মজুত রাখা যাবে। সেখান থেকে দেড় থেকে চার হাজার টনের জাহাজে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে এলপিজি সরবরাহ করা হবে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রে ইতিমধ্যে একটি এলএনজি টার্মিনাল করা হয়েছে। সেখান থেকে এলএনজি সরাসরি গ্যাসের জাতীয় গ্রিডে যাচ্ছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ভোক্তার হাতে সাশ্রয়ী দামে এলপিজি তুলে দিতে হবে। তাই পাইকারি সরবরাহ সরকারের হাতে থাকলে খুচরা পর্যায়েও দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

বাড়ছে এলপিজির চাহিদা

বিপিসি বলছে, উন্নত বিশ্বের মতো যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে এলপিজি ব্যবহারের জন্য অটোগ্যাস সার্ভিস স্টেশন ও রূপান্তর কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। বাসায় রান্নার কাজে প্রতিবছর গ্রাহক বাড়ছে। শিল্পেও অনেকে এলপিজি ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট থাকায় এলপিজির চাহিদা বাড়তেই থাকবে।

২০৪১ সাল নাগাদ দেশে এলপিজির চাহিদা কত হতে পারে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেড। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বর্তমানে ৭০ শতাংশ পরিবার রান্নার কাজে লাকড়ি, শুকনা গোবর ও বায়োমাস ব্যবহার করে। বাকিরা প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপিজি ব্যবহার করে। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে বাসায় নতুন গ্যাস–সংযোগ বন্ধ রয়েছে।

প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ১১ লাখ টনের মতো এলপিজি ব্যবহৃত হয়েছে। এক দশকে দেশে প্রতিবছর এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে গড়ে ৩৫ শতাংশ করে। এটি অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালে চাহিদা হওয়ার কথা প্রায় ৭৮ লাখ টন। তবে সব মিলিয়ে এলপিজির চাহিদা দাঁড়াতে পারে ৭০ লাখ টন।

টার্মিনাল বানাতে চান ব্যবসায়ীরা

বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে মিলে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজটি করতে চায় বেসরকারি কোম্পানিগুলো। এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তারা বলছে, এলপিজি আমদানি বা ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা বিপিসির নেই। এলপিজি সরবরাহকারীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) বলছে, দেশে বর্তমানে এলপিজির ৩৮ লাখ গ্রাহক আছে। চাহিদার ৯৮ শতাংশই পূরণ করছে বেসরকারি খাত।

লোয়াবের সভাপতি আজম জে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহী ঠিকাদার কোম্পানিকে দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটি ঠিক হচ্ছে না। এটি তৃতীয় পক্ষ দিয়ে করা দরকার। আর উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হলে সবাই অংশ নিতে পারবে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, এলপিজি খাত নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। তারা ইচ্ছেমতো দামে এলপিজি বিক্রি করে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দাম নির্ধারণ করে দিলেও তারা মানছে না। জ্বালানি তেলের মতো সরকারিভাবে আমদানি করা হলে এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সরকার। কিন্তু খাতটি নিজেদের হাতে রাখতে চায় দেশের ব্যবসায়ীরা। তাই তারা নানাভাবে সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার বিরোধিতা করছে।

সরকারিভাবে এলপিজি আমদানির পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা রাখতে হবে, আর টার্মিনাল নির্মাণ উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে করতে হবে।