এশিয়ার ছোট দেশগুলোকে সামরিক জোট থেকে দূরে থাকার পরামর্শ

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)

বিশ্বের প্রধান দুই শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতার ফলে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন চোখে পড়ছে। কোরিয়া উপদ্বীপের উত্তেজনা, দক্ষিণ চীন সাগরের অধিকার নিয়ে পাল্টাপাল্টি দাবি, দোকলামে ভারত-চীন সংঘাতের পর বিআরআই আর কোয়াডের প্রতিযোগিতা যোগ করেছে নতুন মাত্রা। দুই প্রধান শক্তির এমন এক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোর কোনো একটিতে যুক্ত হয়ে অন্যটি থেকে দূরে সরে থাকাটা ঠিক হবে না। এশিয়ার ছোট দেশগুলোর কোনো সামরিক জোটে যুক্ত না হওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা আজ বুধবার এ অভিমত ব্যক্ত করেন। মূলত চারপক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপ বা কোয়াডের প্রেক্ষাপটে ‘এশিয়ায় সামরিকীকরণ: ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা’ শীর্ষক ওই ওয়েবিনারের আয়োজন করে সিজিএস।

বেইজিংয়ে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদের সঞ্চালনায় প্রায় দুই ঘণ্টার ওই আলোচনায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্যের পাঁচজন বিশেষজ্ঞ অংশ নেন।

নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিপস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, এ অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা শুধু সামুদ্রিক পরিসরে এখন আর সীমিত নয়। এটি এখন সাইবার স্পেসেও বিস্তৃত হওয়ায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। চীনের অঞ্চল ও পথের উদ্যোগের (বিআরআই) প্রাথমিক লক্ষ্য ব্যবসা, সংযুক্তি ও অবকাঠামো হলেও এটি শুধু অর্থনীতিতেই সীমিত নয়। এটির নিরাপত্তাজনিত প্রভাবও থাকতে পারে। আর মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াড সমমনা চার দেশের ‘সংলাপ উদ্যোগ’। কোনো জোট নয়।

সাবেক ওই জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার মতে, দুই দেশের চলমান প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে এশিয়ার দেশগুলোকে, বিশেষ করে ছোট দেশগুলোকে কোনো সামরিক চুক্তিতে যুক্ত না হওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, দুটির একটিতে যোগ দিয়ে অন্যটিকে প্রতিরোধের নীতিতে যাওয়া ঠিক হবে না। এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিজের দেশের এবং এশিয়ার স্বার্থে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। ছোট দেশগুলোকে নিজেদের কৌশলগত সার্বভৌমত্ব চর্চায় উৎসাহিত করতে হবে।

নয়াদিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিবেকানন্দ ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ ফেলো শ্রীরাধা দত্ত বলেন, চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিতে শুধু সামরিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখাটা ঠিক হবে না। বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ চীনের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তির সামর্থ্যকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আবার কোয়াড যে শুধু সামরিক ও নিরাপত্তার বিষয়টি বলছে তা নয়, অর্থনীতি যেভাবে বদলে যাচ্ছে, সেটাও বলছে। কোভিড-১৯–এর প্রেক্ষাপটে জনস্বাস্থ্য, জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোও শীর্ষ নেতারা তাঁদের যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন। ফলে শুধু টিকা নয়, নানা রকম বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত সহযোগিতার প্রসঙ্গগুলোতে কোয়াডের মনোযোগ রয়েছে। কাজেই কোয়াড মানে যে শুধু চীনকে প্রতিহত করার জন্য এভাবে দেখলে এর ব্যাপকতাকে সীমিত করা হবে। তবে এটাও ঠিক যে কোয়াড চীন কী করছে সেটা যে উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে, সেই বার্তাও চীনকে দেওয়া হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, বাংলাদেশ কিন্তু সামরিক ক্ষেত্রে সব সময় রক্ষণাত্মক নীতি অনুসরণ করে চলেছে। কখনো আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি। রাখাইন থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকে এখন পর্যন্ত সংঘাতে জড়ায়নি। দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনার টেবিলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় রয়েছে। তবে এশিয়ায় সামরিকীকরণ ও কৌশলগত প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে দেশগুলোর ভূমিকা কী হবে, সেটি অর্থনৈতিক প্রয়োজনের নিরিখে ঠিক হবে। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বা এরসেপে যুক্ততার মাধ্যমে বিশ্বের ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যুক্ততায় প্রমাণ হয়।

ওয়েবিনারে আরও বক্তৃতা করেন পাকিস্তানের দ্য সাউথ এশিয়ান স্ট্র্যাটেজিক স্টাবিলিটি ইনস্টিটিউট ইউনিভার্সিটির চেয়ারপারসন ও প্রেসিডেন্ট মারিয়া সুলতান ও বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সাবেক বার্তা সম্পাদক ল্যারি জ্যাগান।