ঐতিহাসিক সোনামসজিদ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনামসজিদ।  ছবি: প্রথম আলো
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনামসজিদ। ছবি: প্রথম আলো

৫০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এক মসজিদ। ছোট সোনামসজিদ। তার প্রাঙ্গণে মুক্তিযুদ্ধের দুই বীর সন্তানের কবর। মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে সীমানাপ্রাচীরের ভেতরেই বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও মুক্তিযুদ্ধে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হকের কবর।

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের পশ্চিম পাশে শায়িত আছেন মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীর মেজর নাজমুল হক। তিনি চট্টগ্রামের সন্তান। ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ রেজিমেন্টের সুদক্ষ কর্মকর্তা।

রাজশাহী থেকে মহাসড়ক হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে ঢুকতেই বিশ্বরোডের মোড়। সেখান থেকে সোনামসজিদ স্থলবন্দর সড়ক হয়ে ছোট সোনামসজিদ ৩৮ কিলোমিটারের পথ। মূল সড়ক থেকে নেমে ডানে অপ্রশস্ত রাস্তা ধরে ৫০-৬০ ফুট এগোলেই উত্তর-পূর্ব দিকে একটি বড় পুকুর। বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে সামান্য এগোলেই ছোট সোনামসজিদের তোরণ।

মধ্যযুগের সুলতানি আমলের গৌড়নগরীর এক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছোট সোনামসজিদ। মসজিদটিকে বলা হতো ‘গৌড়ের রত্ন’। মসজিদের বাইরের দিকে সোনালি রঙের আস্তরণ ছিল। সূর্যের আলো পড়লেই তা সোনার মতো ঝলমল করে উঠত। এ জন্যই এর নাম হয়ে যায় সোনামসজিদ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রধানতম নিদর্শন হচ্ছে ছোট সোনামসজিদ। মধ্যযুগে বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯) নির্মিত হয় সোনামসজিদ। নির্মাতা হিসেবে ওয়ালী মুহাম্মদের নাম পাওয়া যায়। প্রতিবছর দেশ-বিদেশের হাজারো দর্শনার্থী মসজিদটি দেখতে আসেন।

বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বইয়ের প্রধান সমন্বয়কারী নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জকে চেনার একটি প্রতীক এই ছোট সোনামসজিদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে ঐতিহাসিক গৌড়নগরীর আরও স্থাপনা রয়েছে। যাতায়াত, থাকা ও নিরাপত্তার সুবন্দোবস্ত করা গেলে এসব স্থানের পর্যটনকেন্দ্র হয়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

অনন্য নির্মাণশৈলী

সোনামসজিদসংক্রান্ত নানা তথ্য পাওয়া যায় ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালার চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত গৌড় ও পান্ডুয়া স্মৃতি এবং ১৯৮৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রত্ন সম্পদ বইয়ে।

 মসজিদটি ইট দিয়ে তৈরি। তার ওপর পাথরের একটি স্তর বসানো আছে। মসজিদের বাইরের পরিমাপ ৮২ ফুট বাই সাড়ে ৫২ ফুট; ভেতরের পরিমাপ ৭০ ফুট ৪ ইঞ্চি বাই ৪০ ফুট ৯ ইঞ্চি। উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। মধ্যবর্তী তিনটি নামাজের স্থানে খিলান করা চার খণ্ড ছাদ তৈরি করে মাঝখানে এনে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার দুপাশের প্রতি অংশে আছে ছয়টি করে গোলাকার গম্বুজ। এই বারোটির পাশাপাশি চৌচালা গম্বুজ আছে তিনটি। মাঝখানে অবস্থিত এই চৌচালা গম্বুজগুলোর ভেতরের দিকে গোলাপ ফুলের মতো কারুকার্য করা।

মসজিদের চারদিকে চারটি বুরুজ (স্তম্ভ) রয়েছে। এগুলোর ভূমি অষ্টকোনাকৃতির। বুরুজগুলোতে ধাপে ধাপে বলয়ের কাজ আছে। বুরুজগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত। মসজিদের সামনে পাঁচটি এবং ডানে ও বাঁয়ে দুই পাশে তিনটি করে দরজা রয়েছে। প্রতিটি দরজারই কিনারায় আছে বেশ চওড়া করে খোদাই করা কারুকাজ। তবে তা খুব গভীর নয়, দূর থেকে বোঝা যায় না। দরজার পাশের দেয়ালগুলোতেও খোদাই করা কারুকাজ রয়েছে।

মসজিদের প্রবেশপথের পাথরের তোরণটিও সুদৃশ্য কারুকার্যময়। এই তোরণের সামনেই রয়েছে সেই আমলের সারি সারি কবর। সবই বাঁধানো। দুটি কবর বড় কালো পাথর দিয়ে বাঁধানো। এরপরেই মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চোখে পড়বে আমবাগান।

 ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে মসজিদের তিনটি গম্বুজ ও পশ্চিম পাশের দেয়ালের কিছু অংশ বিধ্বস্ত হয়। ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার গম্বুজ ও দেয়ালটি সংস্কার করে। তবে পশ্চিম পাশের ইটের দেয়ালের বাইরের বেশির ভাগ অংশে পাথর স্থাপন করা হয়নি।

মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট ফাটল রয়েছে। গম্বুজেরও জীর্ণ দশা। গত বর্ষায় পানি চুইয়ে পড়েছে। আর সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে প্রতিদিন মালবোঝাই ভারী ট্রাক মসজিদের পাশ দিয়ে যায়। এ সময় কেঁপে কেঁপে ওঠে মসজিদটি। এই কম্পনের কারণে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সোনামসজিদের ইমাম মুহা. হিজবুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত দর্শনার্থীদের ভিড় বেশি থাকে। কোনো কোনো দিন ১০-১২ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। দেশীয় দর্শনার্থীদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, সুইজারল্যান্ড, কুয়েত, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকেরা আসেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন জানালেন, সোনামসজিদসহ গৌড়নগরীর অন্যান্য স্থাপনাকে পর্যটনবান্ধব করতে তাঁরা বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছেন। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে এখানে পর্যটকদের আগমন আরও বেড়ে যাবে।