ওপারে পানি আছে

পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এভাবেই বয়ে চলেছে তিস্তা। পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা বাজার সেতুর কাছ থেকে তিস্তার এই পথচলা ক্যামেরাবন্দী করেছেন ভাস্কর মুখার্জি
পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এভাবেই বয়ে চলেছে তিস্তা। পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা বাজার সেতুর কাছ থেকে তিস্তার এই পথচলা ক্যামেরাবন্দী করেছেন ভাস্কর মুখার্জি
সবাই বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। কিন্তু সেই ভালো সম্পর্কের গলায় তিস্তার কাঁটা খচখচ করছে। ভারতের দুজন প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার এ নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পারেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। মমতা বলেছেন, তিস্তায় দেওয়ার মতো পানি নেই। গত ১৯ ও ২০ এপ্রিল পানি আছে কি নেই, তা দেখতে রংপো থেকে গজলডোবা ও এর আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি অমর সাহা। সঙ্গে ছিলেন ফটোসাংবাদিক ভাস্কর মুখার্জি

তিস্তার উৎস থেকে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির গজলডোবা বাঁধ পর্যন্ত এই শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকলেও এরপরই পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। গজলডোবা বাঁধের এক পাশে টইটম্বুর পানি। আর অন্য পাশে তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে চর। একাধিক বাঁধের বাধা পেরিয়ে আসা স্রোতস্বিনী তিস্তা এখানে এসে স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। এই স্রোতহীন ক্ষীণকায়া তিস্তা চলে গেছে বাংলাদেশে।

তিস্তা যেভাবে এগিয়েছে

তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদীর নাম। জন্ম ভারতের সিকিম রাজ্যে ২৩ হাজার ফুট ওপরে হিমালয়ের পাহুনরি হিমবাহ থেকে। তারপর হিমালয় থেকে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উত্তর সিকিম থেকে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার হয়ে বাংলাদেশে পড়েছে। সেই তিস্তা এখনো বইছে। কোথাও উদ্দাম, কোথাও শ্লথ। কোথাও আবার চর। কোথাও আবার দুই কূল দেখা কঠিন।

এই তিস্তা সিকিমের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে নেমেছে দার্জিলিংয়ের সমতল ভূমি সেবকে। তারপর এখান থেকে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার হয়ে বাংলাদেশে। তিস্তার দৈর্ঘ্য ৪১৪ কিমি। তিস্তা চলেছে সিকিমের ১৫১ কিমি, পশ্চিমবঙ্গের ১২৩ কিমি এবং বাংলাদেশের ১২১ কিমি পথ ধরে। এর মধ্যে আবার ১৯ কিমি পথ সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত ধরে প্রবাহিত হয়েছে। লাচেন, লাংচু, রোঙ্গিচু, রংপো, রঙ্গিত, লিশ, ঘিশ, চেল, নেওরা ও করলা তিস্তার উল্লেখযোগ্য উপনদী।

হিমালয়ের ৭ হাজার ৬৮ মিটার উচ্চতার কাংসে হিমবাহ থেকে সৃষ্টি এই তিস্তার। এখান থেকে লাচেন চু এবং লাচুং চু নামের দুটি নদীর ধারা সিকিমের চুংথান জনপদে নেমে একটি ধারায় তিস্তা নামে এগোতে থাকে। সেটিই আজকের তিস্তা নদী। তারপর এই ধারা চলে আসে সিকিমের রংপোতে। এখানে রংপো নদী মিশে যায় তিস্তার সঙ্গে। রংপো সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত।

রংপো সীমান্ত পার হয়ে সিকিমে ঢুকতে হয়। ভারতীয়রা নিজস্ব পরিচয়পত্র দেখিয়ে ঢুকতে পারে। বিদেশিরা বিশেষ অনুমতি ছাড়া ঢুকতে পারে না। এই রংপো থেকে তিস্তা বাজার সেতু পার হয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে সিকিম থেকে দার্জিলিং জেলায় ঢোকে তিস্তা। তিস্তা সেতু থেকে এই নদী দার্জিলিংয়ের সেবকে সমতলে নামে। তিস্তা বাজার সেতু থেকে রংপোর দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। আর শিলিগুড়ির দূরত্ব ৫০ কিমি। আবার সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের দূরত্ব ৬৪ কিমি। এই তিস্তা বাজার সেতু থেকে একটি পথ দার্জিলিং এবং অন্য একটি পথ গ্যাংটক গেছে। তবে এই তিস্তা রাজধানী গ্যাংটক ছুঁয়ে যায়নি। গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়ি আসতে সিমথনে এই তিস্তা পাহাড়ি পথ ধরে সেবকে নামে। সিমথন থেকে গ্যাংটকের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। সিমথন থেকে এই তিস্তা সেবক হয়ে জলপাইগুড়ি ছুঁয়ে কোচবিহারের পাড় মেখলিগঞ্জের ঝাড় সিংহাসন নামক স্থানে বাংলাদেশে ঢোকে তিস্তা। তারপর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় এসে মিশেছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে।

পানি আছে

কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছে ১৯ এপ্রিল একটি গাড়ি করে পাড়ি জমাই রংপো। রংপো ঘুরে আমরা তিস্তার পার ধরে একেবারে গজলডোবা থেকে মহানন্দা বাঁধে যাব। সঙ্গে আমাদের ফটোসাংবাদিক ভাস্কর মুখার্জি। শিলিগুড়ি থেকে একটি গাড়ি নিয়ে আমরা ছুটলাম রংপোর দিকে। সেখান থেকে ফেরার পথে দেখব তিস্তাকে। কেমন আছে তিস্তা। কেমন করে চলেছে তিস্তা।

রংপো থেকে গজলডোবার দূরত্ব হলো ১১০ কিলোমিটার। এই রংপো থেকে তিস্তা বাজার সেতু পার হয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে আমাদের ফিরতে হবে গজলডোবায়। আমরা ৮০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে সকাল নয়টায় পৌঁছে যাই রংপো। রংপো ঢোকার আগে আমাদের অতিক্রম করতে হয় একটি লোহার সেতু। এই সেতুর একদিকে সিকিম আর অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ। এটিই দুই রাজ্যের সীমান্ত। আমরা এই সেতু দিয়ে সিকিম সীমান্তের গেট পার হয়ে রংপো পৌঁছাই। সেখান থেকে দেখতে দেখতে ফিরতে হবে গজলডোবায়।

আমরা চলেছি পাহাড়ি পথ বেয়ে সিকিম রাজ্যের রংপো থেকে তিস্তা বাজার সেতুর দিকে। সিকিম থেকে দার্জিলিং–শিলিগুড়ি ঢোকার পথ এটি। প্রথমে চোখে পড়ে তিস্তা নদীর ওপর তারাখোলা বাঁধ। ছোট বাঁধ। তিস্তা চলছে একমনে। সামনে তিস্তা বাজার সেতু। রংপো থেকে এই তিস্তা সেতুর দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। আগে এই সেতুটি ঝুলন্ত সেতু ছিল। এখন পাকা সেতু হয়েছে। তিস্তা বাজার সেতু থেকে দার্জিলিংয়ের সেবকে সমতলে নামে তিস্তা নদী। তিস্তা বাজার সেতু থেকেই একটি পথ দার্জিলিং এবং অন্য একটি পথ শিলিগুড়ির দিকে গেছে। এই তিস্তা রাজধানী গ্যাংটক ছুঁয়ে যায়নি। গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়ি আসতে সিমথনে এই তিস্তা পাহাড়ি পথ ধরে সেবকে নামে। সিমথন থেকে রংপোর মাঝে রয়েছে আর একটি বাঁধ।

রংপো থেকে সেবক বা শিলিগুড়ি আসার পথ সত্যিই দুর্গম। সুউচ্চ পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে চলতে হয়। ফলে পাহাড়ি রাস্তার কখনো ডান, কখনো বাঁ দিকে বয়ে চলেছে তিস্তা। সড়কের ওপরে দাঁড়ালে চোখে পড়ে কয়েক শ ফুট নিচে পানির প্রবাহ। তিস্তা বয়ে চলেছে আপন মনে। আবার কখনো তিন–চার পাহাড়ের মাঝে বহমান তিস্তার কতই রূপ। মনে হয়, প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্যের ডালি উজাড় করে দিয়েছে।

তিস্তার পানির দিকে তাকালে বুক কেঁপে ওঠে। কত নিচ দিয়ে চলছে নদী। একবার পড়লে আর রক্ষা নেই। ভয় কাটাতে মনোরঞ্জনের জন্য আছে শত শত বাঁদর। আর আছে সিকিম–দার্জিলিংয়ের পাকা কমলা। পাহাড়ি সড়কের পাশেই কমলার পসরা।

তিস্তার ধার ঘেঁষে এই দীর্ঘ চলার পথে একেবারও চোখে পড়েনি নদীতে পানি না থাকার দৃশ্য। দেখা গেছে, কোথায়ও বেশ পানি। কোথাওবা কম। এ দৃশ্য সিমথন থেকে সেবক পর্যন্ত।

তবে রংপো থেকে গজলডোবায় আসার পথে আরও দুটি বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দেখেছি। এসব প্রকল্পে বাঁধের একদিকে পুরো পানি, অন্য প্রান্তে কম। এখানেই বাঁধ থেকে নিয়মমাফিক পানি ছাড়া হয়ে থাকে। তবে এ দৃশ্য শুষ্ক মৌসুমে। বর্ষাকালে পানির চাপ বাড়লে নিয়মিত পানি ছেড়ে দেওয়া হয়।

তিস্তায় বহু জায়গায় লোকজন মাছ ধরছেন। কেউ জাল দিয়ে, আবার কেউ ছিপ দিয়ে। তিস্তা সেতুর নিচে নামি। এপ্রিলেও তিস্তার পানি প্রচণ্ড ঠান্ডা। মাছ ধরছেন অনেকেই। তাঁদের একজন ভীম বাহাদুর। যুবক ভীমের কাছে জানতে চাই, এখানে কী মাছ পান? ভীম জানালেন, কতলা। বুঝলাম, কাতলা মাছের কথা বলছেন। আমি তখন তিস্তার পারে একটি চরে দাঁড়িয়ে জানতে চাই, এই চর কি বর্ষাকালে এমনই থাকে? ভীম বললেন, ‘ডুবে যায়। নদী তখন ২০ ফুট পর্যন্ত ফুলে ওঠে। স্রোতের টান দেখলে ভয় পেয়ে যাবেন। এখন শান্ত নদী।’ বললাম, কোনো সময় কি এই নদী শুকিয়ে যায়? ভীম বললেন, ‘না। নদীতে সব সময় জল থাকে। তবে এখন কম, বর্ষকালে বেশি। বাঁধে জল আটকে রাখলে জল কম থাকে। ছাড়লে আবার নদীতে জল দেখা যায়।’ কোনো সময় নদীর জল একেবারে শুকিয়ে গেছে কি না, জানতে চাইলে ভীম বাহাদুর জানালেন, ‘না। তবে মাঝেমধ্যে বাঁধে জল আটকিয়ে রাখলে জলের পরিমাণ কম থাকে। কিন্তু নদী একবারে শুকিয়ে যায় না। ক্ষীণ ধারা চলতে থাকে। জল কম থাকলে আবার ড্যাম থেকে ছাড়া হয়। বলতে গেলে ১২ মাসই কমবেশি জল থাকে।’

তিস্তা বাজার সেতুর কাছে দেখা হয় ট্যাক্সিচালক স্যামুয়েল বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বারো মাসই এই পথে ট্যাক্সি চালান। তিস্তার পার দিয়েই যান। তিনি এমন কোনো দিন পাননি যে তিস্তায় জল নেই। তবে বর্ষকালের চেয়ে শীতকালে জলের পরিমাণ কম দেখেছেন। তখন তিস্তার একপাশ শুকিয়ে যায়। সেতুর কাছের এক চায়ের দোকানদারও জানালেন একই কথা।

রংপো থেকে গজলডোবা আসার পথে পড়ে করোনেশন সেতু। এখানেও দেখা গেছে শৌখিন মাছ শিকারিদের। কেউ নৌকায় করে মাছ ধরছেন। করোনেশন সেতু পার হয়ে ডুয়ার্সের পথে তিস্তা পেরিয়ে আসতে হয় গজলডোবায়। এই পথে অবশ্য আসামসহ ভারতের উত্তর–পূর্বের সাতটি রাজ্যে যাওয়া যায়। এটি উত্তর–পূর্ব রাজ্যে ঢোকার দ্বিতীয় পথ।

তিস্তায় যত বাঁধ

রংপো থেকে গজলডোবায় আসার পথে অন্তত তিনটি বাঁধ বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আমাদের চোখে পড়েছে। এগুলো ছোট আকারের। তিস্তা বাজার থেকে গজলডোবায় আসার পথে প্রথমে পড়ে রাম্ভি বাঁধ। এই রাম্ভি থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবাহী মংপুর বাড়িতে যাওয়া যায়। এটি এনএইচপিসি বা জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগমের নিয়ন্ত্রণে। এটিকে বলা হয় লো ড্যাম। এরপর পড়ে কালীঝোড়া ড্যাম। এই বাঁধে রয়েছে সাতটি স্লুইসগেট।

তিস্তাপারের বৃত্তান্ত–এর লেখক দেবেশ রায় ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় এক নিবন্ধে লেখেন, ‘উত্তর সিকিমের লাচুং থেকে দক্ষিণ সিকিমের রংপো পর্যন্ত ২১টি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তাবিত হয়েছে ও কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের আপত্তি সত্ত্বেও অন্তত ৬টি থেকে ৮টি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। সেবকের কাছে সিকিমের ৬টি (ওই প্রস্তাবিত ২১টির মধ্যে) ও পশ্চিমবঙ্গের ২টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ১৫ মিটারের চেয়ে উঁচু বাঁধ তৈরি হচ্ছে। ফলে গাজলডোবার আগেই তিস্তার জল তুলে নেওয়া হচ্ছে। এতে তিস্তার মোট জলের পরিমাণ কত কমছে?’

আর তিস্তার ওপর সবচেয়ে বড় বাঁধটি হলো জলপাইগুড়ির গজলডোবায়। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ। প্রধান বাঁধে রয়েছে ৪৫টি স্লুইসগেট। আর পাশে দুটি ক্যানেলের ওপর তৈরি বাঁধে রয়েছে যথাক্রমে ১৩ ও ৪টি স্লুইসগেট। এই বাঁধের একদিক হলো গজলডোবা, অন্যদিকে মিলনপল্লি। এই গজলডোবা থেকে একটি ক্যানেলের মাধ্যমে তিস্তার পানি সেচের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে মহানন্দা নদীতে। মহানন্দায় তৈরি হয়েছে আরেকটি বাঁধ।

পানি নেই

গজলডোবায় তিস্তা বিশালত্ব নিয়ে আছে। জলাধারের একদিক পানিতে টইটম্বুর। অন্যদিকে পানিশূন্যতা। চর পড়ে গেছে অনেক জায়গায়। তবে নদীর চরের মাঝে মাঝে পানির ক্ষীণ প্রবাহ আছে এই শুষ্ক মৌসুমে। ছোট ছোট ক্ষীণ প্রবাহ চলে গেছে একেবারে মেখলিগঞ্জের বাংলাদেশ সীমান্তে। এখান থেকে ৪০–৫০ কিলোমিটার দূরে কোচবিহারের পাড় মেখলিগঞ্জের ঝাড় সিংহাসন সীমান্ত। সেখান থেকে তিস্তা ঢুকেছে বাংলাদেশে। জলপাইগুড়ির এক নদী বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেছেন, এখন শুষ্ক মৌসুম। গজলডোবা থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত তিস্তা নদীতে এখন তেমন পানি নেই। নদীতে চর পড়েছে। আবার এই নদীই বর্ষাকালে ফুলে–ফেঁপে ওঠে। ছাপিয়ে যায় দুই কূল। তিনি আরও বলেন, এই গজলডোবার নিচের দিকে আরেকটি তিস্তা সেতু রয়েছে। এটি জলপাইগুড়ির তিস্তা সেতু নামে পরিচিত। এই সেতুর পাশ দিয়ে রয়েছে রেললাইন। আগে এখানে সেতু ছিল না। তখন এই তিস্তা নদী পার হতে হতো নৌকায় করে। এমনকি বাস ও গাড়িঘোড়া চলত জোড়া নৌকার ফেরিতে করে। এক পাশে ছিল জলপাইগুড়ির কাছারিঘাট আর অন্য পাড়ে বার্নিশ ঘাট। ট্রেনের বা সড়কপথের যাত্রীরা এখানে নেমে তিস্তা পার হতেন নৌকায় করে। তারপর উঠতেন ট্রেনে বা অন্য যানবাহনে। এখন সেই তিস্তা নেই। নেই পানিও। আবার এখান থেকে কিছু দূরে এই তিস্তা নদীর ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। এটি কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ ও হলদিবাড়িকে যুক্ত করবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গজলডোবা থেকে তিস্তার উৎসমুখের মানুষ পানি পেলেও বঞ্চিত হচ্ছে গজলডোবার নিচের দিকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত তিস্তাপারের মানুষজন। নদীর দুই ধারে জলপাইগুড়ি-ময়নাগুড়ি-লাটাগুড়ি-মেখলিগঞ্জ- হলদিবাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ প্রাপ্য পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে উত্তরবঙ্গের এই কৃষিপ্রধান এলাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হয়। এ কারণে তিস্তার দুপারের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজনের অভাবের শেষ থাকে না। তবে এই গ্রীষ্মে কিছু জায়গায় গভীর নলকূপের জল দিয়ে চাষাবাদেরও সাময়িক ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও নদীতে পানি থাকলে তার প্রয়োজন হতো না। এ চিত্র দেখা গেছে গজলডোবা থেকে দোমোহনি, কাছারিঘাট, বার্নিস, মণ্ডলঘাট, মেখলিগঞ্জ, হলদিবাড়ি সর্বত্র।

তবে চেহারা বদলে যায় বর্ষা মৌসুমে। তখন যৌবন ফিরে পায় তিস্তা। দুই কূল ভাসিয়ে দেয় তিস্তার জলরাশি। প্রসঙ্গত, গজলডোবার বাঁধ নির্মিত হয় ২০০৭ সালে। এটির উচ্চতা ২৮৫ ফুট। এটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ৬০ মেগাওয়াট। এই গজলডোবায় শুষ্ক মৌসুমে পানি কম থাকলেও বর্ষাকালে থাকে পানির প্রচণ্ড চাপ। গজলডোবার এক হোটেল ব্যবসায়ী বিনয়ভূষণ সাহা বলেছেন, পর্যটকেরা এই বাঁধ দেখতে দূর–দূরান্ত থেকে আসেন এখানে। এখানেই পর্যটকদের জন্য গড়া হচ্ছে একটি উন্নত মানের রিসোর্ট। হোটেলের ম্যানেজার টুম্পা সাহা বলেন, তিস্তা নদীর প্রধান মাছের মধ্যে রয়েছে বোরোলি মাছ। ছোট মাছ। পর্যটকেরা এখানে এসে এই মাছের স্বাদ নিতে ভোলেন না। আর মিলছে তিস্তার চিংড়ির সুস্বাদু চপ। বোরোলি ছাড়া এখানে মেলে নদীয়ালি, টেংরা, মহাশোল, ডেকরা, চিংড়ি এবং বাগাড়। এক পর্যটক বলেন, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর প্রিয় মাছ ছিল এই বোরোলি।

এই বাঁধের কাছেই তিস্তা ব্যারাজের কন্ট্রোল রুম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ দপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন এই ব্যারাজ। ব্যারাজে গিয়ে এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বলেন, তথ্য নিতে হলে যোগাযোগ করতে হবে কলকাতায় রাজ্য সেচ দপ্তরে। তবে তিনি তিস্তা–সংক্রান্ত কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেন। এখানে তিস্তা নিয়ে কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা তৃণমূলের নেতারা কথা বলতে চান না।

এই তিস্তা বাঁধ থেকে ক্যানেলের মাধ্যমে প্রবাহিত করা পানি মহানন্দার সঙ্গে মিলিত হওয়ার স্থলেও তৈরি করা হয়েছে আরেকটি বাঁধ। এটির নাম মহানন্দা ব্যারাজ। এর অবস্থান জলপাইগুড়ি জেলার ফুলবাড়ীতে। সেই বাঁধও দেখলাম। এই ড্যামের ওপর দেখা মিলল শত শত পরিযায়ী পাখির। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। প্রতিবছরই এই পখিরা এখানে আসে।