ওড়াকান্দিতে মোদির সফর আমাদের আন্দোলনের স্বীকৃতি: সুব্রত ঠাকুর

সুব্রত ঠাকুর

হিন্দু নিম্নবর্ণের মানুষের সামাজিক জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে স্বীকৃত হরিচাঁদ ঠাকুর। ১৮১২ সালের ১১ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি গ্রামে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে হরিচাঁদ ঠাকুর ‘মতুয়া আন্দোলন’ শুরু করেন। হরিনামে মাতোয়ারা হওয়ার সংস্কৃতি থেকে এই সম্প্রদায় নিজেদের ‘মতুয়া’ বলে পরিচয় দেয়। তরুণ বয়সেই হরিচাঁদ বুঝেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া বর্ণ বঞ্চনার দেয়াল ভাঙা সম্ভব নয়। ‘শিক্ষাতেই মুক্তি’—হরিচাঁদের এই দর্শন প্রচার করেন ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুর। বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রায় তিন কোটি মতুয়ার কাছে ওড়াকান্দি পবিত্রতম স্থান। মতুয়াদের ভাষায়, ২৭ মার্চ শনিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওড়াকান্দি সফর সেই অনুভূতিতে বড় স্বীকৃতি এনে দেবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর, মতুয়া সমাজের এখনকার পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে শুক্রবার দুপুরে টেলিফোনে আলাপ হয় হরিচাঁদ ঠাকুর বংশের উত্তর পুরুষ কাশিয়ানী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুব্রত ঠাকুরের (৪৬) সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক কাজী আলিম-উজ-জামান।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: খুব ব্যস্ত বুঝি?

সুব্রত ঠাকুর: দম ফেলার সময় নেই। দৌড়ের ওপর আছি। আমাদের দিক থেকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষায় আছি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন?

সুব্রত ঠাকুর: আমি হরিচাঁদ ঠাকুরের ষষ্ঠ পুরুষ। আমার বাবা মতুয়াচার্য হিমাংশুপতি ঠাকুর বাংলাদেশ মতুয়া মহাসংঘের সংঘাধিপতি ছিলেন। গত বছরের জানুয়ারি মাসে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। চার দশক ধরে মতুয়া অনুসারীদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন আমার বাবা। এখন আমি মতুয়া মহাসংঘের নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ২০১৯ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আমি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। আমরা দুই ভাই এক বোন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়া সম্প্রদায়কে একতাবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু একতার সেই জমিতে আজ বিভেদের আল। এই বিভেদ কি আদর্শগত নাকি নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থেকে?

সুব্রত ঠাকুর: ভারতে এই বিভাজন কিছুটা হলেও দেখা দিয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের একটা অংশ দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয় চলে যান। সেখানে অনেকেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। একটি বড় অংশ বিজেপির সঙ্গে আছেন। অন্য অংশ তৃণমূল ও বামপন্থীদের সঙ্গে। তবে সম্প্রদায়গত আত্মিক টান সবার মধ্যে বজায় রয়েছে বলে বিশ্বাস করি। আর বাংলাদেশে মতুয়া সমাজের বিভাজন খুব একটা প্রকট নয়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মতুয়া সমাজের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। আমি ছাড়া বলতে গেলে মতুয়া সমাজে বিশেষ কোনো জনপ্রতিনিধি নেই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের দর্শনে নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে শিক্ষাসহ উন্নতির ধারা বজায় ছিল, বিভেদ-কলহে তা ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন কি?

সুব্রত ঠাকুর: সময় একটা ফ্যাক্টর, সময়ের আবর্তনে মতুয়া সমাজে শাখা-প্রশাখা বেড়েছে। কোনো কিছুই এক রকম থাকবে না। কেবল মূল আদর্শটা ঠিক আছে কি না, সেটা দেখতে হবে। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কারণে বৃহত্তর আদর্শ বিনষ্ট হয়। তারপরও এটা ঠিক যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করা সাধারণ মতুয়ারা বঞ্চিত মানুষের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের জন্য, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর সুরক্ষার জন্য তাঁরা কাজ করছেন। প্রতিবছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে পুণ্যস্নানের সময় মতুয়ারা মিলিত হন। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়া আরও কয়েকটি দেশ থেকে মতুয়ারা শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে আসেন। সে সময় আয়োজকদের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষজন ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় পুণ্যার্থীদের থাকা-খাওয়া ও দেখাশোনার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। উৎসবে আমরা সবাই একতাবদ্ধ হই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আর মাত্র একটা প্রশ্ন করব। ভারতের পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওড়াকান্দি সফরের মধ্যে ভোটের রাজনীতির একটা বড় ব্যাপার আছে। পরদিনই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন শুরু। আবার কেউ বলছেন, বনগাঁর ঠাকুরনগরে মতুয়াদের মধ্যে নানা সংকট রয়েছে। তাই ওড়াকান্দির দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। আপনার কী মত?

সুব্রত ঠাকুর: এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না। নরেন্দ্র মোদি নিজেও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। অতিথি হিসেবে আমরা তাঁকে স্বাগত জানাতে চাই। তাঁর সফরকে ২১০ বছর আগে আমার পূর্বপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার আদায় ও উন্নয়নের জন্য যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তারই একটা স্বীকৃতি হিসেবে দেখি।

প্রথম আলো: ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সুব্রত ঠাকুর: আপনাকেও ধন্যবাদ।