ওয়ার্ডে পশুর বিচরণ

১৬ নভেম্বর বেলা ১১টা ১০ মিনিট। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি ওয়ার্ডে ঘোরাঘুরি করছে একটি ছাগল l ছবি: মঈনুল ইসলাম
১৬ নভেম্বর বেলা ১১টা ১০ মিনিট। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি ওয়ার্ডে ঘোরাঘুরি করছে একটি ছাগল l ছবি: মঈনুল ইসলাম

গত সোমবার বেলা ১১টা ১০ মিনিট। রোগীশূন্য ওয়ার্ড। শূন্য শয্যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বোতল, খালি বাক্স। মেঝেতেও একই অবস্থা। স্ট্যান্ডে ঝুলছে ব্যবহৃত স্যালাইনের ব্যাগ। দেয়াল স্যাঁতসেঁতে। মেঝেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাগল। ভেতরে ঢুকতেই উৎকট দুর্গন্ধ।
এই চিত্র রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি ওয়ার্ডের। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে ওয়ার্ডটির এমনই দুরবস্থা দাঁড়িয়েছে। ওয়ার্ডের ভেতরে থাকার মতো কোনো পরিবেশ নেই।
বছরের পর বছর এভাবে চলে এলেও পরিস্থিতির উন্নয়নে পদক্ষেপ নেই। চিকিৎসক-কর্মকর্তাদেরও অভিযোগ, সমস্যা সমাধানে হাসপাতালের পরিচালকের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বহুবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা দূর হয় না।
হাসপাতালের সাবেক পরিচালক আবদুল কাদের খান বলেন, ‘আমি পরিচালক ও উপপরিচালক থাকা অবস্থায় দীর্ঘ তিন বছরে বহুবার এই ওয়ার্ডের দুরবস্থা দূর করার উদ্যোগ নিয়েছি। ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি লিখতে লিখতে আমরা হয়রান হয়ে পড়েছি। কিন্তু ওপর মহল থেকে শুধু আশ্বাসই দেওয়া হয়।’
হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক আ স ম বরকতুল্লাহ বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। এরপরও বুধবার সেখানে গিয়েছি। দুরবস্থা দেখেছি। এবার আমি নতুন উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি, দুরবস্থার বিহিত করতে পারব।’
মূল হাসপাতাল ভবন থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে এই ওয়ার্ডটি অবস্থিত। ১৯৬০ সালে বর্তমান সিটি করপোরেশনের সামনে সদর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল ওই সময়ের একমাত্র হাসপাতাল। ১৯৭৬ সালে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চালু হলে সদর হাসপাতাল বিলুপ্ত করে এটি হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি ওয়ার্ডে রূপান্তরিত করা হয়। এখানে ডায়রিয়া, টিটেনাস, জলাতঙ্ক ও বসন্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
বিধ্বস্ত জরাজীর্ণ একতলা ভবনের এই ওয়ার্ডে মোট চারটি কক্ষ। একটি কক্ষে ডায়রিয়া ও কলেরা রোগীদের জন্য আটটি এবং টিটেনাস রোগীদের জন্য চারটি শয্যা রয়েছে। অন্য দুটি কক্ষের একটি চিকিৎসকের এবং বাকিটি জরুরি বিভাগ ও নার্সদের বসার জন্য ব্যবহৃত হয়।
গত সোমবার সরেজমিনে পরিদর্শনের সময় ওয়ার্ডটিতে একজন রোগীও ভর্তি ছিলেন না। শুধু কর্তব্যরত নার্সকে পাওয়া যায়। রোগী না থাকায় চিকিৎসক আগেই চলে গেছেন বলে নার্স জানালেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার আবার সরেজমিনে গেলে ওয়ার্ডটিতে দুজন রোগী ভর্তি পাওয়া যায়। মোজাম্মেল হোসেন (৫৫) ডায়রিয়ার রোগী। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘এত নোংরা ও অপরিষ্কার জায়গাত চিকিৎসা কইরবার আসলে আরও অসুস্থ হয়া যাওয়া লাগবে।’ টিটেনাসে আক্রান্ত মোতাল্লেব হোসেন (৬০) বলেন, ‘এত বড় একটা মেডিকেল থাকতে এটে কেনে চিকিৎসা দেওয়া হয়?’
গতকালও চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে কর্তব্যরত চিকিৎসক উম্মে হাবিবা বলেন, ‘ওখানে নিয়মিতই যাওয়া হয়। পরিবেশ ভালো না। বসে থাকার মতো অবস্থা নেই। তেমন রোগীও থাকে না। তাই চলে আসি।’
ওয়ার্ড সূত্র জানায়, এখানে কখনো রোগী ভর্তি থাকে, কখনো থাকে না। থাকলেও সংখ্যায় খুবই কম—দিনে গড়ে দু-তিনজন। ২ নভেম্বর রোগী ভর্তি ছিল দুজন, ৪ নভেম্বর তিনজন ও ৬ নভেম্বর দুজন। ৫ নভেম্বর কোনো রোগী ছিল না। ওয়ার্ডে কর্তব্যরত জ্যেষ্ঠ নার্স নার্গিস বেগম বলেন, হাসপাতাল থেকে দূরে হওয়ায় ওয়ার্ডটির এ অবস্থা দূর হচ্ছে না।
এসব কারণে ওয়ার্ডটি হাসপাতালের মূল ভবনে নেওয়ার এবং ওয়ার্ডটি পুনরায় সদর হাসপাতালে রূপান্তরিত করার দাবি জানিয়ে আসছে রংপুরের নাগরিক সমাজও। রংপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মোশফেকা রাজ্জাক নগরবাসীর সুবিধার জন্য এই স্থানে নতুন একটি হাসপাতাল গড়ে তোলারও দাবি জানিয়েছেন।
হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদেরও ভাষ্য, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ওয়ার্ডে গিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব নয়। হাসপাতালের মূল ভবনে ওয়ার্ডটি স্থানান্তর হলেই রোগীদের দুর্ভোগ আর থাকবে না।