ওয়াসার এমডিদের ‘যাঁরা প্রশ্ন করেন’, তাঁরাই বাদ পড়ছেন

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কার্যক্রমের জবাবদিহি করতে হয় বোর্ডের কাছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি নিয়ে দেশের চারটি ওয়াসা বোর্ড গঠিত। কোনো পেশাজীবী সদস্য একাধিকবার দায়িত্বে থাকলে প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তাঁদের জানাশোনা বাড়ে, তাঁরা অনিয়ম–দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। এসব কারণে অনেক ক্ষেত্রে অস্বস্তিতে পড়তে হয় ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি)।
 
একই ব্যক্তিকে একাধিকবার ওয়াসার বোর্ড সদস্য হিসেবে মনোনয়ন না দিতে পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তাতে ওয়াসা বোর্ডে নতুন মেয়াদে প্রতিনিধি মনোনয়নের ক্ষেত্রে নতুন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে বলা হয়েছে। যদিও ওয়াসা আইন অনুযায়ী, এক ব্যক্তির একাধিকবার বোর্ড সদস্য হতে বাধা নেই।

পেশাজীবী প্রতিনিধিরা বলছেন, বোর্ড সদস্য হিসেবে অভিজ্ঞ লোক থাকলে প্রতিষ্ঠানের লাভ। অভিজ্ঞ সদস্যরা এমডিদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এমডিদের স্বার্থরক্ষায় মন্ত্রণালয় এমন নির্দেশনা দিয়েছে বলে তাঁরা অভিযোগ করেন। অন্যদিকে মন্ত্রণালয় বলছে, ওয়াসার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যই পেশাজীবী সংগঠন থেকে নতুন সদস্য দিতে বলা হয়েছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার সদ্য বিদায়ী বোর্ড সদস্য ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা বোর্ড সদস্যদের পরিবর্তে এমডিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া দরকার ছিল।

কারণ, চিঠিগুলোতে যে কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে একজন বোর্ড সদস্যের জড়ানোর সুযোগ নেই। বরং দীর্ঘ সময় ধরে এমডির কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং দুদকও তদন্ত করছে।

দেশের চারটি ওয়াসার মধ্যে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান, চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ এবং খুলনা ওয়াসার এমডি মো. আবদুল্লাহ ২০০৯ সাল থেকে দায়িত্বে রয়েছেন। সেবার মান নিয়ে সমালোচনা ও নানা বিতর্কের মুখে পড়লেও তাঁরা এমডি পদে বারবার পুনর্নিয়োগ পেয়েছেন। রাজশাহী ওয়াসার এমডি জাকীর হোসেন সরকারি কর্মকর্তা। গত বছর তিনি নিয়োগ পেয়েছেন।

ওয়াসার আইন ১৯৯৬–এর ৬ ধারায় বোর্ড গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে। ওয়াসা বোর্ডে যে সাতটি পেশাজীবী সংগঠন থেকে প্রতিনিধি থাকে সেগুলো হচ্ছে— চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যন্টস, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এবং ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ।

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদাধিকারবলে বোর্ড সদস্য হন। স্থানীয় সরকার এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন করে প্রতিনিধি (কমপক্ষে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার) থাকেন। ওয়াসার আওতাধীন এলাকার মধ্যে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থাকলে সেটির প্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর বোর্ড সদস্য হন।
সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ শাখা থেকে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, বিভিন্ন সংগঠন ওয়াসা বোর্ডে একই ব্যক্তিকে বারবার প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দিচ্ছে। এতে বোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষ লাভের পরিবর্তে স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। ওয়াসার দাপ্তরিক ও প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি শেখ শফিউল আজম প্রথম আলোকে বলেন, বোর্ড সদস্যদের কারণে তো প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ কমে না। বরং ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা (এমডি) বারবার থাকলে উৎকর্ষ কমে। বোর্ডের সদস্যরা এমডিদের নানা অনিয়ম–দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘আসলে ওনারা (এমডি) বাঁচার জন্য এটা করছেন। বোর্ড সদস্য হিসেবে অভিজ্ঞ লোক থাকলে বরং প্রতিষ্ঠানের লাভ।’

ওয়াসা আইনের ৬ (৪) ধারায় বলা হয়েছে, বোর্ডের সদস্যরা ৩ বছরের জন্য দায়িত্বে থাকবেন এবং পুনরায় নিয়োগের জন্য বিবেচিত হবেন। আইনি বাধা না থাকলেও মন্ত্রণালয় থেকে পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে নতুন সদস্য মনোনয়ন দিতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পানি সরবরাহ) মুহম্মদ ইবরাহিম প্রথম আলোকে বলেন, পেশাজীবী সংগঠন থেকে একাধিকবার যাঁরা ওয়াসার বোর্ড সদস্য হয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ ওয়াসার সঙ্গে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে স্বার্থের সংঘাত দেখা দিচ্ছে। এমন কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নতুন নাম প্রস্তাব করতে বলা হয়েছে।
ওয়াসার এমডিদের স্বার্থ রক্ষায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মুহম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘এমডি ছাড়াও বোর্ডে তো ১২ জন সদস্য থাকেন। এমডিরা বোর্ড সদস্যদের জন্য বরং চাপে থাকেন। এমডিরা একনায়কতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন, এটি বললে খামাখা বলা হবে।’

তবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের তিনজন সদস্য বলছেন, ওয়াসায় যেকোনো সিদ্ধান্তে এমডির অবস্থানই প্রাধান্য পায়। ওয়াসার বোর্ড সদস্যদের দায়িত্ব ওয়াসার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। একাধিকবার বোর্ড সদস্য হলে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কে জানাশোনা বাড়ে। সদস্যদের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে এমডিদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে পানির দাম বাড়ানো, নিয়োগ ও বেতন–ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে অভিজ্ঞ সদস্যরা ভূমিকা রাখতে পারেন।