কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের সভাপতি মাহমুদুল হাসান, মহাসচিব মাহফুজুল হক

সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও মহাসচিব পদে এসেছেন মাওলানা মাহফুজুল হক।

দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার (বেফাক) সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন মাওলানা মাহমুদুল হাসান। মহাসচিব পদে এসেছেন মাওলানা মাহফুজুল হক।

সভাপতি পদে মাহমুদুল হাসান পেয়েছেন ৬৬ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী পেয়েছেন ৫০ ভোট। মহাসচিব পদে মাহফুজুল হক পেয়েছেন ৭৩ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মাওলানা মুসলেহুদ্দীন পেয়েছেন ৪০ ভোট।

বেফাকের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের (মজলিসে আমেলা) সভায় গোপন ভোটে তাঁরা নির্বাচিত হন। শনিবার রাজধানীর কাজলার ভাঙা প্রেস এলাকায় বেফাকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভোট গ্রহণ করা হয়। অবশ্য এটাকে ভোটাভুটি বলতে রাজি নন কওমি আলেমরা। তাঁরা বলছেন, এটা সদস্যদের লিখিত মতামত।

বেফাকের নতুন সভাপতি মাহমুদুল হাসান রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়ার মুহতামিম এবং গুলশানের আজাদ মসজিদের খতিব। আর মহাসচিব মাহফুজুল হক প্রয়াত শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের ছেলে। তিনি মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম (প্রধান)। তিনি এর আগে বেফাকের সহকারী মহাসচিব ছিলেন।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুতে বেফাক ও কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সরকার গঠিত সংস্থা আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়ার সভাপতি পদটি শূন্য হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যিনি বেফাকের সভাপতি হবেন, তিনিই হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান হবেন।

মাহফুজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইসলামের বিধানে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। তাই এখানে কেউ প্রার্থী ছিলেন না, ভোটাভুটিও হয়নি। তবে সুশৃঙ্খলভাবে মতামত ব্যক্ত করার জন্য সবাই লিখিতভাবে মতামত দিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সভাপতি ও মহাসচিব হয়েছেন। এর ফলাফল বাইরে না যাওয়ার ব্যাপারেও সবাই সম্মত হয়েছেন।’

বেফাকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, সভাপতি পদে কেউ ঘোষণা দিয়ে প্রার্থী হননি। সদস্যরা জ্যেষ্ঠ আলেমদের মধ্য থেকে তাঁদের পছন্দমতো সাতজনকে ভোট দেন। তবে আগে থেকেই বেফাকের সভাপতি পদে মাহমুদুল হাসান ও জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার মুহতামিম (প্রধান) নূর হোসাইন কাসেমী আলোচনায় ছিলেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে সভাপতি পদে তিনজন ভোট দিয়েছেন। বাকি চারজনের মধ্যে মাওলানা আব্দুর রহমান হাফেজ্জী এবং মাওলানা সাজিদুর রহমান দুই ভোট করে পেয়েছেন। অন্য দুজন এক ভোট করে পেয়েছেন। বেফাকের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ১৪৭ জন সদস্যের মধ্যে ১২৫ জন সভায় উপস্থিত ছিলেন। সবাই ভোটে অংশ নিয়েছেন।

বেফাকের সহসভাপতি মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাছের নেতৃত্বে চারজন জ্যেষ্ঠ আলেম নির্বাচন পরিচালনা করেন। তাঁরা হলেন খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদ্রাসার মুহতামিম নূরুল ইসলাম জিহাদি, শায়েস্তাগঞ্জের মাদ্রাসায়ে নূরে মদিনার মুহতামিম নূরুল ইসলাম ওলিপুরী ও ঢালকানগর মাদ্রাসার মুহতামিম আল্লামা জাফর আহমদ। তিনজনই বেফাকের সহসভাপতি।

সভাপতি পদে নির্বাচনের পর মাওলানা নূরুল ইসলাম জিহাদি বেফাকের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি পদে নূর হোসাইন কাসেমীর নাম প্রস্তাব করেন। তা সমর্থন করেন জুনায়েদ বাবুনগরী। পরে মাহমুদুল হাসানও তাতে সমর্থন দিলে সবাই তা গ্রহণ করেন।

মাহমুদুল হাসান বেফাকের সভাপতি হওয়ায় তিনি সরকার গঠিত সংস্থা আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়ারও চেয়ারম্যান হবেন। আবার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যিনি বেফাকের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হবেন, তিনি হাইআতুল উলয়ারও কো-চেয়ারম্যান হবেন। ফলে নূর হোসাইন কাসেমী হাইআতুল উলয়ারও কো-চেয়ারম্যান হবেন।

১৯৭৮ সালে বেফাক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সর্বশেষ সভাপতি ছিলেন শাহ আহমদ শফী। হেফাজতে ইসলামের মতো বেফাকও কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেফাকের অধীন ছয়টি স্তরের সারা দেশের ১৩ হাজার মাদ্রাসা আছে। এসব মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। কওমি শিক্ষার সনদের সরকারি স্বীকৃতি থাকায় এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। এই সুবাদে সরকারের সঙ্গে কওমি আলেমদের যোগাযোগও বেড়েছে। তাই বেফাকের নেতৃত্ব নিয়ে বেশ কিছু ধরে নানামুখী তৎপরতা চলছিল। এ নিয়ে সরকারঘনিষ্ঠ ও সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়।

বেফাকের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, আহমদ শফীর মৃত্যুতে হাটহাজারী মাদ্রাসার নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ার পর তাঁর অনুসারীরা বেফাকের শীর্ষ পদে পছন্দের ব্যক্তিদের বসাতে তৎপর ছিলেন। তাঁদের প্রতি সরকারঘনিষ্ঠ মহলের সমর্থন ছিল বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। এই অংশ যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মুহতামিম মাহমুদুল হাসানকে বেফাকের সভাপতি পদে জোর সমর্থন দেয়। শেষ মুহূর্তে এই অংশের সঙ্গে যুক্ত হন চরমোনাইপীরের দল ও তাদের অনুসারী সদস্যরা। তাঁরা মহাসচিব পদে মাওলানা মুসলেহুদ্দীনকে চেয়েছিলেন। কিন্তু সভাপতি পদে মাহমুদুল হাসান জিতে যাওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায় বলে জানান একজন মাদ্রাসার শিক্ষক। এরপর মহাসচিব পদে জয়ী হন মাহফুজুল হক। অবশ্য তাঁর সঙ্গেও সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের যোগাযোগ আছে বলে প্রচার আছে।

শনিবার বেলা ১১টায় বেফাকের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি পুরান ঢাকার জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদ্রাসার মুহতামিম আবদুল কুদ্দুছের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভা হয়। তিনি গতকালের সভায় পদত্যাগ করেন। সম্প্রতি তাঁর একটি ফাঁস হওয়া ফোনালাপে বেফাকে অনিয়মের কিছু ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি সমালোচনার মুখে পড়েছেন।

গতকালের সভায় জ্যেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন মধুপুরের পীর মাওলানা আবদুল হামীদ, চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ রেজাউল করীম, মাওলানা নূরুল ইসলাম জিহাদী, মাওলানা আবদুল বারী ধর্মপুরী, মাওলানা শায়খ জিয়াউদ্দীন, মাওলানা আবদুল হক, মুফতি আহমদ আলী, মাওলানা আবদুর রশীদ, মাওলানা নুর আহমদ কাসেম, মাওলানা মিজানুর রহমান সাঈদ, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফিজ্জী প্রমুখ।