কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি দিতে কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ

সরকারের এ উদ্যোগ প্রতিহতের ঘোষণা আলেমদের
সরকারের এ উদ্যোগ প্রতিহতের ঘোষণা আলেমদের

কওমি মাদ্রাসাশিক্ষার স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৩’ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে মাদ্রাসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাদানের জন্য ‘কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সচিব পদমর্যাদার দুজন সরকারি কর্মকর্তা ও শীর্ষস্থানীয় আলেমদের সমন্বয়ে এই কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে।জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ‘কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনে আইনের খসড়া করার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, কওমি শিক্ষা কমিশনের সদস্যরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছেন, তার আলোকে এটি করা হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।এদিকে কওমি ধারার শীর্ষস্থানীয় আলেমরা সরকারি এই উদ্যোগের বিরোধিতা শুরু করেছেন। তাঁরা এ উদ্যোগ প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে ‘কওমি মাদ্রাসা সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করেছেন। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলামসহ কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে কওমি মাদ্রাসাগুলোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এর ফলে দেশে কওমি শিক্ষার অস্তিত্ব ও স্বাধীন ধর্মীয় চর্চার অপমৃত্যু ঘটবে।ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও ‘কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের উদ্যোগের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছেন।প্রসঙ্গত, সরকারনিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন আলিয়া মাদ্রাসার বাইরে দেশে অন্তত ১০ হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণও নেই। বেসরকারিভাবে পরিচালিত এসব কওমি মাদ্রাসা মূলত ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে থাকে। এসব মাদ্রাসার শিক্ষাসনদের সরকারিভাবে কোনো স্বীকৃতি নেই। কওমি ধারার আলেমরা বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় থেকে শিক্ষাসনদের সরকারি স্বীকৃতি দাবি করে আসছেন। বর্তমান মহাজোট সরকার মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে এই দাবি পূরণে কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে।কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ও এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে খসড়া আইনে মোট ২০টি ধারা ও বেশ কিছু উপধারা রয়েছে। এতে বলা হয়, সরকার প্রজ্ঞাপন দ্বারা যে তারিখ নির্ধারণ করবে, সে তারিখ থেকে এ আইন বলবৎ হবে। এতে কওমি শিক্ষার স্বীকৃতির বিষয়টিও যুক্ত রয়েছে।
কর্তৃপক্ষ গঠন: খসড়া আইনের ৬(১) ধারায় বলা হয়, ‘কওমি শিক্ষা, ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি, আরবি ভাষা ও সাহিত্য, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং ধারা ৫(খ)-তে উল্লিখিত সদস্যগণ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।’ ধারা ৫(খ)-এ কওমি শিক্ষাক্ষেত্রে পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় আলেম, মহিলা কওমি মাদ্রাসার একজন প্রতিনিধি, সরকারের যুগ্ম সচিব বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার একজন সরকারি প্রতিনিধি, পদাধিকারবলে সচিব ও কওমি মাদ্রাসা বোর্ডগুলোর প্রধানেরা এর সদস্য হবেন।

ক্ষমতা ও কার্যাবলি: ধারা ৯-এ বলা হয়, এই কর্তৃপক্ষ কওমি মাদ্রাসার কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, মাদ্রাসা পরিদর্শনের পদ্ধতি নির্ধারণ, কওমি বোর্ডগুলোর কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন এবং চার স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে। যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করবে।

এ ছাড়া পৃথক কওমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই কর্তৃপক্ষ কওমি উচ্চশিক্ষার দুটি স্তর—স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর দাওরা-ই-হাদিস পর্যায়ের মাদ্রাসাগুলোর অ্যাফিলিয়েটিং অথরিটি (অধিভুক্তি দেওয়ার কর্তৃপক্ষ) হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। শিক্ষার মান উন্নয়নে কওমি মাদ্রাসা স্থাপন, প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা এবং এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে পাঠাবে।

অন্যান্য কার্যক্রম: খসড়া আইনের ধারা ১০, ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৭-তে কর্তৃপক্ষের সভা, তহবিল গঠন, বাজেট, বার্ষিক প্রতিবেদন সম্পর্কে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, কর্তৃপক্ষ প্রতি দুই মাসে অন্তত একটি সভা করবে। প্রতিটি সভার কার্যবিবরণী ও গৃহীত সিদ্ধান্তের অনুলিপি সরকারের কাছে পাঠাতে হবে। গৃহীত সিদ্ধান্ত এ আইন বা ‘জাতীয় শিক্ষানীতির পরিপন্থী’ হলে তা বাতিল বা সংশোধন করার জন্য বা কার্যকর না করার জন্য সরকার নির্দেশনা দিতে পারবে এবং সে অনুসারে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

মতামত চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়: গত ১৭ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এই খসড়া আইনের বিষয়ে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) কাছে মতামত চাওয়া হয়।

বেফাকের মহাপরিচালক আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খসড়া আইনটি সংসদের এ অধিবেশনে পাস করার বিষয়ে সরকারের মনোভাবের কথা জানান এবং দ্রুত মতামত দিতে বলেছেন। অবশ্য গতকাল পর্যন্ত বেফাক কোনো মতামত দেয়নি।

বেফাক সূত্র জানায়, খসড়া আইনের সব দিক পর্যালোচনা করে শীর্ষস্থানীয় আলেমদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাতে কওমি মাদ্রাসার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অভিযোগ তুলে এই আইন প্রত্যাখ্যান করা হয়।

দ্বন্দ্বের শুরু: সরকারের সঙ্গে কওমি ধারার আলেমদের দ্বন্দ্ব শুরু হয় গত বছরের ১৫ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসাশিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কমিশন গঠন করার পর থেকে। বেফাকের সভাপতি ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে ১৭ সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়। এর কো-চেয়ারম্যান হন শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, সদস্যসচিব হন গোপালগঞ্জের গওহরডাঙা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রূহুল আমীন। এ দুজনকে সরকারসমর্থক বলে মনে করেন বাকি আলেমরা।

আহমদ শফী কো-চেয়ারম্যান-১ পদে মাওলানা আশরাফ আলীকে ও সদস্যসচিব পদে আবদুল জব্বারের নাম দিয়ে কমিশন পুনর্গঠন করার দাবি জানান। একই সঙ্গে বেফাকের নামে কওমি সনদের স্বীকৃতি দেওয়া, বেফাককে অ্যাফিলিয়েটিং ইউনিভার্সিটি করা, সরকারি অনুদান গ্রহণ না করা ও কওমি মাদ্রাসার পাঠপদ্ধতি পরিবর্তন না করাসহ আটটি প্রস্তাব করেন। এসব দাবি পূরণ না হওয়ায় দুটি বৈঠকের পর আহমদ শফী কমিশনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। চলতি বছরের ৯ মার্চ শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম সংগঠিত হয়। ৬ এপ্রিল লংমার্চ ও ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আলোচনায় আসেন সংগঠনটির আমির আহমদ শফী।

প্রস্তাবিত আইনটি প্রত্যাখ্যানের কারণ জানতে চাইলে বেফাকের মহাসচিব আবদুল জব্বার বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে শুধু কওমি শিক্ষার সনদের স্বীকৃতি চেয়েছি। এর বিনিময়ে আমরা সরকারের কাছে চাকরি বা অনুদান চাই না। কিন্তু আইন দেখে মনে হচ্ছে, সরকার স্বীকৃতির নামে কওমি মাদ্রাসাকে নিয়ন্ত্রণের একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছে।’

অবশ্য কওমি শিক্ষা কমিশনের কো-চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দিন মাসউদ প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা আইনটি প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁরা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। তাঁরা হয়তো মনে করেছেন, আগামী দিনে বিএনপির সরকার ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি নেবেন। তিনি বলেন, ‘তাঁরা যতই বলেন মানি না মানি না, সময় কিন্তু বসে থাকবে না।’