কঠোর বিধিনিষেধেও চা-বাগান খোলা, ক্ষোভ

চা-বাগানে মাস্ক ছাড়া কাজ করেন শ্রমিকেরা। শীলঘাট ফাঁড়ি বাগান, জুড়ী, মৌলভীবাজার। ২৬ জুলাই।
ছবি: কল্যাণ প্রসূন

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চলছে কঠোর বিধিনিষেধ। এর মধ্যেও অন্যান্য এলাকার মতো মৌলভীবাজারের জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলার চা-বাগানগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। চা-শ্রমিকেরা বলছেন, দিন দিন করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে বাগানেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই বাগান খোলা রাখা সমীচীন হয়নি। তবে বাগান কর্তৃপক্ষ বলছে, চা বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে বাগান খোলা রাখা হয়েছে। করোনা প্রতিরোধে নেওয়া হয়েছে নানা কার্যক্রম।

১৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়েছে, ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধে দেশের সব শিল্পকারখানা বন্ধ থাকবে। পরে ১৯ জুলাই জারি করা আরেকটি পরিপত্রে খাদ্য ও খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন/প্রক্রিয়াজাতকরণ মিল-কারখানা আরোপিত বিধিনিষেধের আওতার বাইরে থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিনই চা বোর্ড একটি নোটিশ দেয়। নোটিশে চা–খাদ্যদ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত উল্লেখ করে চা উৎপাদন ও নিলাম কার্যক্রম চালু রাখার অনুরোধ করা হয়। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধিসহ বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়। চা বোর্ডের নোটিশ পেয়ে ২৩ জুলাই থেকে বাগান খোলা রাখা হয়। দেশে মোট চা–বাগানের সংখ্যা ১৬২। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে পড়েছে ৯০টি।

সরেজমিনে গতকাল সোমবার ও আজ মঙ্গলবার ঘুরে দেখা গেছে, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলার বিভিন্ন চা-বাগানে নারী শ্রমিকেরা চায়ের কুঁড়ি সংগ্রহ করছেন। পুরুষেরাও নানা কাজে ব্যস্ত। অধিকাংশ শ্রমিকের মুখে মাস্ক নেই। চায়ের কুঁড়ি ওজন দেওয়ার সময় লাইনে দাঁড়ানো নারী শ্রমিকদের কারও কারও মুখ শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখা। দুপুরে দল বেঁধে বসে খাবার খান। খাবারের আগে শুধু পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেন। কোথাও জীবাণুনাশক সাবান ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। এসব বাগানের কারখানায় চা প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ চলছে। ট্রাকে করে এক বাগানের শ্রমিক আশপাশের এলাকার অন্য বাগানে গিয়েও কাজ করেন।

মাস্ক না পরার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জুড়ীর শীলঘাট ফাঁড়ি বাগানের শ্রমিক ললিতা গয়াসূর বলেন, ‘কোম্পানি মাস্ক দিছে। কিন্তু এইটা লাগাইলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এ লাগি পরি না। কেউই পরে না।’

কঠোর বিধিনিষেধে দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানা বন্ধ। অথচ চা-বাগান খোলা। এটা ঠিক হয়নি।
মোহন রবিদাস, চা-শ্রমিক অধিকারকর্মী

চা-শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে কাজ করেন চা-শ্রমিক পরিবারের সন্তান মোহন রবিদাস। তাঁর বাড়ি কমলগঞ্জের শমশেরনগর চা-বাগানে। ২৪ জুলাই তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভে একটি বাগানে দলবদ্ধ হয়ে নারী শ্রমিকদের খাবারের চিত্র দেখিয়ে বলেন, করোনা থেকে শ্রমিকদের সুরক্ষিত রাখতে বাগান কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বেশির ভাগ বাগানে শ্রমিকেরা মাস্ক, হ্যান্ডস্যানিটাইজার, জীবাণুনাশক সাবান পাননি। বাগানের বিভিন্ন লাইনে শ্রমিকেরা ঘনবসতিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন। সেখানে করোনার সংক্রমণ হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। কঠোর বিধিনিষেধে দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানা বন্ধ। অথচ চা-বাগান খোলা। এটা ঠিক হয়নি।

জুড়ী ও পার্শ্ববর্তী বড়লেখা উপজেলায় আকিজ টি কোম্পানি চারটি বাগান পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) কাজল মাহমুদ বলেন, চা বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে বাগান খোলা রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সচেতন করার হচ্ছে। বাগানে এ পর্যন্ত কোনো শ্রমিক করোনায় সংক্রমিত হননি জানিয়ে তিনি বলেন, জুড়ীতে প্রতিষ্ঠানের ধামাই, সোনারুপা ও আতিয়াবাগান বাগানের ১৫০ শ্রমিক করোনার প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন। টিকার জন্য নিবন্ধনের বিষয়ে শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

চা বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে বাগান খোলা রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সচেতন করার হচ্ছে।
কাজল মাহমুদ, উপমহাব্যবস্থাপক, আকিজ টি কোম্পানি

চা-বাগানে স্বাস্থ্যবিধির অবস্থা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জুড়ী ও কুলাউড়ার তিনটি চা-বাগানের ব্যবস্থাপকেরা। তবে নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তাঁরা। ওই ব্যবস্থাপকদের ভাষ্য, চা-শ্রমিকদের বুঝিয়েও স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব হয় না। মাস্ক পরতে রাজি হন না তাঁরা। অবাধে ঘোরাঘুরি করেন। ব্যবস্থাপকেরা বলছেন, জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চায়ের ভরা মৌসুম। এখন সবুজ কুঁড়ি গজাচ্ছে। এ সময়ে কুঁড়ি তোলা সম্ভব না হলে পরে তা শক্ত হয়ে যাবে। মানসম্মত চা হবে না। চা-শিল্প আর্থিক ক্ষতিতে পড়বে। এ অবস্থায় চা–শিল্পকে বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।

চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বাগানে কিছু কাজ আছে, তাতে এমনিতেই সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে। যেমন চায়ের কুঁড়ি সংগ্রহের কাজ। শ্রমিকেরা নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে তা করেন। কিন্তু কাজে আসা, কাজ থেকে ফেরা ও দুপুরের খাবার সময় শ্রমিকেরা দলবদ্ধ হয়ে পড়েন। এতে ঝুঁকি থেকে যায়। বিভিন্ন বাগানে শ্রমিকদের করোনার উপসর্গ রয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিটি বাগানের শ্রমিকদের নমুনা পরীক্ষার দরকার। এ ছাড়া এ সময়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করায় শ্রমিকদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া দরকার।