কবি ও তাঁর জীবনকল্লোল

বেলাল চৌধুরী

কবি বেলাল চৌধুরীর (১৯৩৮-২০১৮) এক জীবনে যেন বিচিত্র জীবনের বর্ণচ্ছটা। কলকাতার কৃত্তিবাস থেকে ঢাকার সচিত্র সন্ধানী, ভারত বিচিত্রা পত্রিকা সম্পাদনায় তাঁর কৃতি ও খ্যাতি আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। আত্মপ্রতিকৃতি স্থিরজীবন ও নিসর্গ, স্বপ্নবন্দী, যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাস-এর মতো কবিতাগ্রন্থের কবি পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের প্রিয় কবিদের কবিতা অনুবাদেও ছিলেন বিশেষ মনোযোগী; গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাস মৃত্যুর কড়ানাড়া অনুবাদের পাশাপাশি মার্কেসের অনুবাদক গ্রেগরি রাবাসার তরজমা-সাধনা নিয়ে লিখতেও তিনি ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ। অ্যালেন গিন্সবার্গ থেকে গুন্টার গ্রাস; বিশ্বসাহিত্যের এমন বহু বিশিষ্টের সঙ্গে ছিল তাঁর বিশেষ সখ্য। তাঁদের স্মৃতিচর্চার পাশাপাশি সাহিত্যমূল্যায়নেও ছিলেন আমৃত্যু ব্রতী। কবিতার মতো গদ্যের গহন অরণ্য ছিল তাঁর নিজস্ব এলাকা; যাঁরা বেলাল চৌধুরীর গদ্যগ্রন্থ নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়, সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে, জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন বা শামসুর রাহমান: রূপালি আঙুলের ঝর্নাধারা পড়েছেন, তাঁরা সে সত্যের সাক্ষাৎ পাবেন।

একক ও যৌথভাবে গ্যেটে, পাবলো নেরুদা, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর স্মরণীয় কিছু স্মারকগ্রন্থ থেকে মন্বন্তরের গল্পসংকলন লঙ্গরখানা বা জলের মধ্যে চাঁদ ও অন্যান্য জাপানি গল্প সম্পাদনার তথ্য তাঁর বৈচিত্র্যপিপাসারই পরিচয়বহ।

বেলাল চৌধুরীর জীবন নিয়ে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত হলেও কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যনির্ঝরে যেন স্বপ্নছবির মতো ভেসে ওঠে ১৯৬৩-এর দিকে বছর ২৫ বছরের এক যুবকের সমুদ্রকল্লোল থেকে জীবনকল্লোলের টানে কলকাতায় গমন ও কলকাতা-যাপনের চিত্র—‘সে নাকি জাপানে ট্রলি-বোঝাই এ্যলিগেটর নিয়ে আসছিল, সমুদ্রে ভাসিয়ে। তারপর, ভাসমান এ্যালিগেটর জলে ভেসে গেল। একাকী বেলাল আছে সমুদ্রবেলায় পড়ে। সাধারণত, কলকাতায় বৃষ্টি শুরু হয় জুন ও জুলাই। যাহোক-তাহোক করে বেলাল উঠেছে। পুবের সূর্যের মতো। অভিসন্ধি! কোনো কিছু নেই। বেলাল বালক শুধু হলুদ নদীর তীরে...তারপর, বেলা গেছে। শাল সেগুনের ছায়া বেলালকে নিয়েছে সর্বদা।’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায় গদ্যসংগ্রহ; খণ্ড ৪, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা)

আর কলকাতা নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বই আমার কলকাতায় (প্রথমা প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০১৮, দ্বিতীয় মুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৯) বেলাল চৌধুরী বলছেন, ‘জীবনসমুদ্র মন্থন করে পশ্চিম বাংলার কলকাতায় যখন নোঙর ফেললাম ষাটের দশকের শুরুতে ইংরেজদের স্মৃতিবহ কলকাতায়। কলকাতায় আমি যেমন হঠাৎ করে আকাশ থেকেও পড়িনি, তেমনি মাটি ফুঁড়েও বেরোইনি। তাহলে? ভাসতে ভাসতে গিয়ে ঠেকেছিলাম কলকাতা বন্দরের হুগলি নদীর চড়ায়।’

এই বই কলকাতার সূত্রে যেন যৌবনবেগ জলতরঙ্গে নিমজ্জনেরই রোমহর্ষ গল্প। রেলকর্তা বাবার সন্তান বেলাল কোনো ঐন্দ্রজালিক কু-ঝিক-ঝিক শব্দ শুনে নিজ গ্রাম ফেনীর শর্শদি, সন্দ্বীপ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ঢাকায় এলোমেলো কালখণ্ড কাটিয়ে একসময় পাড়ি দেন স্বপ্নের কলকাতায়। এর আগে চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করতে গিয়ে অল্প বয়সেই যেতে হয় কারাগারের অন্ধকারে। কিন্তু সেই অন্ধকারেই তিনি পেলেন হঠাৎ আলোর ঝলকানির দেখা। জেলখানায় বন্দী প্রখ্যাত বামপন্থী কর্মী, লেখক, বুদ্ধিজীবীরা যেমন তাঁর মননরেখা গড়ে তোলেন, তেমনি সেখানে আসা সীমিতসংখ্যক পত্রপত্রিকায় নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে লেখা সোমনাথ লাহিড়ীর গল্প পড়ে কিংবা ননী ভৌমিকের পোস্টকার্ড পেয়ে হয়েছেন উদ্দীপিত। জেলজীবনে গোগ্রাসে দেশি-বিদেশি সাহিত্য পড়তে পড়তে অন্তরমহলে অজান্তেই যেন এসে হানা দিয়েছে দূর অজানার হাতছানি। কারামুক্ত হয়ে পত্রিকার কাজ থেকে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জাহাজ, কত জায়গাতেই করেছেন বিচরণ আর এর ফাঁকেই পড়া হয়েছে কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রা, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কুয়োতলা কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প ‘বাঘ’। প্রিয় পাঠের সূত্রেই যেন কলকাতা তাঁকে টানছিল অমোঘ। তারপর অরূপরতন বসুর ভাষায়, ‘কোন জাদুবলে যে বেলাল এক সম্পূর্ণ অপরিচিত বিশাল শহর, কলকাতার হৃদয় জয় করে ফেললেন, তা তাঁদের বোঝানো যাবে না, যাঁরা তখনকার বেলালকে দেখেননি।’ (সংবাদ প্রতিদিন, ১৮ মে ১৯৯৭)

আমার কলকাতা, বেলাল চৌধুরী, প্রথমা প্রকাশন

কলকাতার কবরখানায়, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ায়, কালীঘাটের শিখ গুরুদুয়ারায়, কফি হাউসে, খালাসিটোলায়, দূরের আদিবাসী মহল্লায় সানন্দ-উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়ে বেলাল বিস্ময় জাগালেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভেতরও, ‘কলকাতার এক অজ্ঞাত কবরখানায় বেলাল যেভাবে দিনযাপন করেছে তাতে মনে হয়েছে, এ ছেলে নিশ্চিত কোনও ছদ্মবেশী রাজকুমার।’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অর্ধেক জীবন, আনন্দ পাবলিশার্স ২০১২)

তবে বেলাল চৌধুরী ভবঘুরে কলকাতা-জীবনে আড্ডায় মুখর থাকার পাশাপাশি সৃষ্টিতেও ছিলেন সমান সোচ্চার। পূর্ব্বাশা, বাংলা কবিতা কিংবা কৃত্তিবাস-এ কবিতা লিখে সুধীজনের প্রশংসা পান। ১৯৬৪ সালে নিষাদ প্রদেশে, ১৯৭২ সালে বেলাল চৌধুরীর কবিতা বই দুটোও প্রকাশ পায় কলকাতা থেকে। কবিতার সঙ্গে সঙ্গে নানা ছোট ও বড় কাগজে লিখেছেন গদ্য, ফিচার, কড়চাজাতীয় লেখা। কমলকুমার মজুমদার সম্পাদিত অঙ্কভাবনা পত্রিকায় গণিতবিষয়ক গদ্য থেকে নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত এক্ষণ পত্রিকায় অনুবাদ করেছেন হোর্হে লুই বোর্হেসের গল্প। সম্পাদনা করেছেন দৈনিক কবিতা নামের শৌখিন পত্রিকা এবং কৃত্তিবাস পত্রিকার স্মরণীয় কয়েকটি সংখ্যা।

কেমন কেটেছে বেলাল চৌধুরীর কলকাতার দিনরাত্রি? অপরূপ উত্তর পাওয়া যাবে আমার কলকাতার পৃষ্ঠা-পরিসরে, ‘তখন আমাদের কিবা দিন কিবা রাত্রি, পারলে চব্বিশ ঘণ্টাই কাটাই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে। মেইন গেট আনুষ্ঠানিকভাবে সকাল ন’টায় খোলার কথা হলেও আমরা কফি হাউসিয়ানরা জানতাম ঠিক পৌনে ন’টায় কফি হাউস খোলার তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত সেই সাড়ে আটটা থেকেই। সুতরাং আমরা সবজান্তার ভেতরটার সুলুক ধরে আগেভাগে ঢুকেই বসে যেতুম নিজেদের পছন্দের টেবিলে।’

অবিরাম আড্ডার ঢেউয়ে ঢেউয়ে কখনো কবিতার পঙ্‌ক্তিতেও ধরতে চেয়েছেন হাওড়া ব্রিজের বিভঙ্গ, ‘বিশাল এক রূপালি ঢেউ যেন তার/পেলব ইস্পাত নির্মাণ-পেছনে/ তাসের পিঠের ছবির মতন/ চকচকে নীল এলুমিনিয়াম আকাশ;/ অদূরে অবিশ্রাম প্রবহমানতায়/ গুঞ্জরিত সধূম রেলস্টেশন।’ (হাওড়া ব্রিজের ঠাট ও কারুকৃতি)

উন্মাতাল কলকাতা-জীবনে একসময় দেখা পেয়েছেন শপথে বলীয়ান বাংলাদেশকে। এই বইয়ের ‘কলকাতায় একাত্তর’ অংশে আছে মুক্তিযুদ্ধের মৈত্রী-মোহনায় কূটনৈতিক পাড়া থেকে কফি হাউসের আড্ডারুদের জেগে ওঠার প্রসঙ্গ।

পরিবারের আদরের সন্তান দূর শহরে। বাড়িতে স্নেহময়ী মা তার পুত্রহারা বেদনায় লিখে চললেন চিরসুমধুর শিরোনামের একগুচ্ছ কবিতা। স্বজনেরা দফায় দফায় দেশে ফেরার অনুরোধ নিয়ে বিফল হলেও সাল ১৯৭৪-এ বাবার অসুস্থতার খবরে, মায়ের আদেশে কলকাতা ছাড়লেন বেলাল চৌধুরী। যেন দুরন্ত জাহাজের ডাঙা-বাস্তবতা মেনে নেওয়া। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতার দিনরাত্রি, তুষার রায়ের শেষ নৌকা উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে ভাস্বর রইলেন সে সময়ের বেলাল আর মুহূর্তভাষ্যতে তিনি এভাবেই এঁকে রাখলেন কলকাতাকালীন যৌবনের অস্থির আত্মপ্রতিকৃতি, ‘সমুদ্রভ্রমণ শেষে ফিরে এসেছি কলকাতায়। আমি নির্নিমেষ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে হারিয়ে ফেলি মুখের ভাষা, আমার খোলস খুলে যেতে থাকে। আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠি। আমার সব প্রত্যয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গড়িয়ে পড়ে। আমি অর্থহীনভাবে বেঁচে আছি যেন। আমার এই দ্বৈতসত্তার নৈর্ব্যক্তিক স্বরূপই আমার প্রেক্ষিত; প্রকারান্তরে যেখানে একই বোধশক্তি কাজ করে যাচ্ছে, বেঁচে থাকা এবং মৃত্যুরহস্যের চাবিকাঠি খুঁজছে যুগপৎ।’

শুভ জন্মদিন কবি, শুভ বিরাশি।