কম শোনার বড় কারণ কানের মধ্যে ময়লা

দেশের জনসংখ্যার ৯ দশমিক ৬ শতাংশ বিভিন্ন মাত্রায় বধিরতায় ভোগে। এর মধ্যে কানে ময়লা জমার কারণে কম শোনে ১২ শতাংশ। তবে কানের ময়লা নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

বিশ্ব শ্রবণ দিবস উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ সোসাইটি অব অটোলজির উদ্যোগে ‘বধিরতা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ তথ্য জানানো হয়। রাজধানীর ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। এই প্রবন্ধে ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচি থেকে বেশ কিছু তথ্য উপস্থাপন করেন তিনি।

ভারতে বিনা মূল্যে হিয়ারিং এইড দেওয়া হয়। বাংলাদেশে মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে যন্ত্রটির দাম অনেক বেশি পড়ে যায়। ফলে সীমিত আয়ের মানুষ তা কিনতে পারে না। এটা সহজলভ্য করা উচিত।
অধ্যাপক কামরুল হাসান তরফদার, সার্ক ইএনটি সোসাইটির সভাপতি

আজ বুধবার (৩ মার্চ) বিশ্ব শ্রবণ দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে দিবসটির প্রচলন হয়েছে। বিশ্বজুড়ে শ্রবণশক্তি সুরক্ষার সচেতনতা তৈরি করতে এটি পালিত হয়। দিবসটি উপলক্ষে ডব্লিউএইচও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ২০১৯ সালের হিসাব তুলে ধরে বলা হয়েছে, বিশ্বে শ্রবণ সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৬০ কোটি। ২০৫০ সাল নাগাদ সংখ্যাটি প্রায় আড়াই শ কোটিতে দাঁড়াতে পারে। এর মানে হলো তখন বিশ্বে প্রতি চারজনের একজন শ্রবণশক্তির সমস্যায় ভুগবে।

সোসাইটি অব অটোলজির আলোচনা সভায় তুলে ধরা জরিপ অনুসারে, শব্দদূষণের কারণে প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ, মধ্য কর্ণের প্রদাহের (সিএসওএম) কারণে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং মধ্য কর্ণে পানি জমার (ওএমই) কারণে ৬ শতাংশ মানুষ কানে কম শোনে। এর বাইরে বয়সের কারণে কানে কম শোনা মানুষের হার সাড়ে ৩৫ শতাংশ।

প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ‘অটিজম অ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার যেমন একটি জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা, তেমনি শ্রবণ সমস্যাও একটি জনস্বাস্থ্যজনিত সমস্যা। আজকের দিনে করোনাভাইরাসের মহামারিও একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এমনকি ধূমপানও এ তালিকায় রয়েছে। কিন্তু এই জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যাগুলো নিয়ে স্কুল কিংবা কলেজে আমরা পড়াশোনা করিনি।’ তিনি বলেন, এসব সমস্যা সমাধানে জনসচেতনতা বেশি জরুরি। সচেতনতা তৈরির জন্য রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত কাজ করতে হবে।

দিবসটি উপলক্ষে ডব্লিউএইচও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ২০১৯ সালের হিসাব তুলে ধরে বলা হয়েছে, বিশ্বে শ্রবণ সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৬০ কোটি। ২০৫০ সাল নাগাদ সংখ্যাটি প্রায় আড়াই শ কোটিতে দাঁড়াতে পারে। এর মানে হলো তখন বিশ্বে প্রতি চারজনের একজন শ্রবণশক্তির সমস্যায় ভুগবে।

প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ যখন হয়, তখন দেশের জনসংখ্যা ধরা হয়েছিল ১৪ কোটি ২০ লাখ। এই জরিপে উঠে আসে যে আটটি সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ কানে কম শোনে। ১৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় বধিরতায় ভোগা শিশুর সংখ্যা ৬ শতাংশ। ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে এই হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে হারটি সবচেয়ে বেশি, সাড়ে ৩৫ শতাংশ। এ ছাড়া প্রতি লাখে চারটি শিশু শ্রবণজনিত সমস্যা নিয়ে জন্মায়। আলোচনা সভায় শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার ফলাফল উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বয়স্কদের ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। শ্রবণশক্তি কমে গেলে একজন প্রবীণের হতাশা কিংবা স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ যদি এই সমস্যায় আক্রান্ত হন, তাহলে তিনি একাকিত্বে ভুগতে পারেন।

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত বাংলাদেশের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর বধিরতার চিকিৎসা সক্ষমতার চিত্রও তুলে ধরেন। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ভারতে ইএনটি সার্জনের (নাক, কান, গলা চিকিৎসক) সংখ্যা ৮ হাজার। বাংলাদেশে তা ৬০৪ জন। ভারতে অডিওলজিস্ট রয়েছেন প্রায় ৪ হাজার। আর বাংলাদেশে অডিওলজিস্ট রয়েছেন মাত্র ১০ জন। ভারতে শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষক রয়েছেন ১৮ হাজারের বেশি। বাংলাদেশে রয়েছেন ১৬০ জন।

আলোচনা সভায় বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় অডিওলজি বিভাগের উন্নয়ন, জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা বৃদ্ধি, হিয়ারিং এইড (কৃত্রিম শ্রবণসহায়ক যন্ত্র) সহজলভ্য করা, সচেতনতা সৃষ্টি এবং শব্দদূষণ কমানো।

সার্ক ইএনটি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক কামরুল হাসান তরফদার বলেন, ভারতে বিনা মূল্যে হিয়ারিং এইড দেওয়া হয়। বাংলাদেশে মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে যন্ত্রটির দাম অনেক বেশি পড়ে যায়। ফলে সীমিত আয়ের মানুষ তা কিনতে পারে না। এটা সহজলভ্য করা উচিত। তিনি বলেন, যাঁদের বয়স ৬০ বছরের বেশি, তাঁদের বিনা মূল্যে হিয়ারিং এইড দেওয়া উচিত সরকারের।

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক খোরশেদ মজুমদার বলেন, নিজে কান পরিষ্কার করা কোনোভাবেই ঠিক নয়। ভেতরে যে ময়লা জমে, সেটা এমনিতেই পরিষ্কার হয়। আর ময়লা শক্ত হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। নইলে ঝুঁকি থাকে।

আলোচনা সভায় পপুলার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এম আবদুল্লাহ, বিএসএমএমইউয়ের অধ্যাপক বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী, অধ্যাপক নাসিমা আখতার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. আবু ইউসুফ ফকির, সোসাইটি অব অটোলজির সভাপতি অধ্যাপক আবুল হাসনাত জোয়ারদার, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের নাক কান ও গলা বিভাগের অধ্যাপক শেখ নুরুল ফাত্তাহ, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ খান, ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মোসাদ্দেক হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।