ময়মনসিংহে শিল্পায়ন
কমেছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা
ময়মনসিংহ জেলায় বর্তমানে ১ হাজার ১১৩টি নিবন্ধিত শিল্পকারখানা আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত।
একসময়ের খরস্রোতা খিরু নদ এখন দখল আর দূষণে বিপর্যস্ত। খালগুলোও কারখানার বর্জ্যের দূষণে প্রাণ হারিয়েছে। এই হাহাকার যেন এখন পুরো ভালুকাবাসীর। এমন নির্মম বাস্তবতার বিপরীতে স্বস্তির খবর—অর্থের মানদণ্ডে ভালুকাবাসীর জীবনমান কিছুটা উন্নত হয়েছে, বেকার ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় শিল্পায়নের বিস্তার ঘটায় এমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
প্রায় ৩৫ বছর আগে ভালুকায় শিল্পায়ন শুরু হয়। বিত্তশালীরা যখন ঢাকার বাইরে ও অদূরে নিজেদের শিল্পকারখানা করতে শুরু করলেন, তখন প্রথমে গাজীপুর ও পরে ভালুকায় শিল্পায়ন শুরু হয়। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায় সেই শিল্পায়ন এখন ভালুকা পার হয়ে ত্রিশালেও বিস্তার লাভ করেছে।
কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের হিসাবে, ময়মনসিংহ জেলায় বর্তমানে ১ হাজার ১১৩টি নিবন্ধিত শিল্পকারখানা আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই ভালুকা ও ত্রিশালে অবস্থিত। শুরুর দিকে বেশির ভাগই ছিল পোশাকশিল্প। পরবর্তী সময়ে এসেছে অন্যান্য ভারী শিল্পের কারখানা। ভালুকায় শিল্পায়নের সূচনা হয় ১৯৮৬-১৯৮৭ সালে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করে শিল্পকারখানা। তবে ২০০০ সালের পর যেন বিপ্লব ঘটে যায়। শুরুর দিকেই স্কয়ার গ্রুপের মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠান ভালুকায় কারখানা তৈরি করে। বর্তমানে লাবীব, এনভয় ও বসুন্ধরার মতো বড় প্রতিষ্ঠান ভালুকায় কারখানা চালাচ্ছে। বছর চারেক আগে যুক্ত হয় কোকাকোলার মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। মোটরসাইকেল তৈরির প্রতিষ্ঠান রানার মোটরসাইকেলের কারখানা রয়েছে ভালুকায়। টিভিএস মোটরসাইকেল তৈরির কারখানাও আছে এখানে। আছে রেনেটা ও বীকন ফার্মার কারখানা। আর আকিজ গ্রুপ কারখানা করেছে ত্রিশালে।
শুরুতে ঢাকা থেকে যাতায়াত সহজ হওয়ায় কারখানামালিকদের চোখ পড়ে ভালুকায়। জমিরদিয়া বাজার ও আশপাশের এলাকায় জমির দাম এখন আকাশচুম্বী। সেখানে এক শতক জমির দাম প্রায় কোটি টাকা। শিল্পায়নের প্রভাবে মানুষের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। একসময় দারিদ্র্য আর বেকারত্বের কারণে প্রচুর চুরি–ডাকাতি হতো। এখন সেসব আর নেই। মানুষ কিছু না কিছু করে খেতে পারছে।
ভালুকা পৌরসভার তথ্যমতে, বর্তমানে পৌর এলাকায় আছে ২৩৩টি কারখানা। এসব কারখানায় অন্তত দেড় লাখ শ্রমিক কাজ করেন। পুরো ভালুকা উপজেলায় বর্তমানে প্রায় ৫০০টি ছোট–বড় শিল্পকারখানা আছে। এসব কারখানায় অন্তত ১০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন শ্রমিকেরা। এসব শ্রমিকের থাকার জন্য বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন স্থানীয় মানুষ। সড়কের মোড়ে মাছ-মাংস আর সবজির দোকান করেও দরিদ্র মানুষেরা সচ্ছল জীবন যাপন করছেন।
শিল্পায়নের এই আশীর্বাদের বিপরীতে অভিশাপ হয়ে উঠেছে পরিবেশদূষণ। ২০ বছরে প্রায় মরে গেছে ভালুকার ব্র্যান্ডখ্যাত খিরু নদ। দখল আর দূষণই যেন এখন খিরু নদের চিত্র। ভালুকার বানার ও লাউটি নদেরও প্রায় একই অবস্থা। মরাপুরা আর বিলাইজুড়ি নামের দুটি খালের অস্তিত্বই কোথাও কোথাও বোঝা যায় না। ভালুকার মানুষের ভাষ্য, ডায়িং কারখানা, ওষুধ কারখানা ও সিসা কারখানাগুলো এই দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। বেশির ভাগ কারখানায় নেই বর্জ্য শোধনাগার। যেসব কারখানার বর্জ্য শোধনাগার আছে, তারা রাতে শোধনাগার বন্ধ রাখে। ফলে বর্জ্য স্থানীয় নদ–নদী ও খালে পড়ে দূষণ ছড়াচ্ছে।
ভালুকার বাসিন্দা কবি সফিউল্লাহ আনসারী বলেন, শিল্পায়নের কারণে ভালুকার মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে, মানুষ এখন আর খাবারের কষ্ট করে না—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য শিল্পকারখানার বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় পরিবেশদূষণ চরম আকার ধারণ করেছে। ভালুকার মানুষ শিল্পায়ন চায়, পাশাপাশি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশও চায়।