করোনা বাড়লেও গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়

করোনাকালে বাল্যবিবাহ এবং পরিস্থিতি উন্নয়নে করণীয় বিষয়ক মিডিয়া ক্যাফে। সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘নিরাপদ ইশকুলে ফিরি’ ক্যাম্পেইনের আওতায় এটি অনুষ্ঠিত হয়।ছবি: প্রথম আলো

করোনার নতুন ধরন অমিক্রন ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি আবারও বন্ধ করে দিতে হয় তখন যাতে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা কার্যক্রম কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। কারণ, দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং গ্রামাঞ্চলে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম সেভাবে চালাতে না পেরে অভিভাবকেরা মেয়ের বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হয়েছেন। অভিভাবকেরা যাতে মেয়েকে বোঝা মনে না করেন, সে জন্য মেয়েদের উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।

আজ বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন, প্রথম আলো এবং কিশোর আলোর যৌথ আয়োজনে অনলাইনে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মিডিয়া ক্যাফে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। এতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন কিশোর আলোর সম্পাদক এবং প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক।

ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার আগে ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সী বিবাহিত তরুণীদের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ৫১ ভাগের বিয়ে হয়েছিল ১৮ বছর বয়সের আগে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘নিরাপদ ইশকুলে ফিরি’ ক্যাম্পেইনের আওতায় ‘করোনাকালে বাল্যবিবাহ এবং পরিস্থিতি উন্নয়নে করণীয়’ বিষয়ক এ মিডিয়া ক্যাফে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

আলোচনায় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাভিডেন্স অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জের টিম লিড আবু সাঈদ মো. জুয়েল মিয়া বলেন, কোনো বেসলাইন বা ভিত্তি জরিপের তথ্য নেই বলে করোনায় ঠিক কত শতাংশ বাল্যবিবাহ বেড়েছে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার আগে ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সী বিবাহিত তরুণীদের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ৫১ ভাগের বিয়ে হয়েছিল ১৮ বছর বয়সের আগে। আর করোনার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর গত সেপ্টেম্বরে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলল তখন প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর ছিল কত মেয়ে স্কুলে ফিরতে পারেনি। এমনও দেখা গেছে, একটিমাত্র মেয়ে স্কুলে ফিরেছে, অন্যরা ফিরতে পারেনি, কেননা করোনায় তাদের বিয়ে হয়ে গেছে।

আবু সাঈদ মো. জুয়েল মিয়া বলেন, ব্র্যাকের গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ৬ হাজার ৩০০ খানায় পরিচালিত (এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসের তথ্যের ভিত্তিতে) জরিপের ফলাফল বলছে, খানাগুলোর ৩৯ ভাগ মেয়েই বাল্যবিবাহের শিকার হয়। ৩০ শতাংশেরই বিয়ে হয় ১৬ বছর বয়সের আগে। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে একটি গুণগত গবেষণায় অভিভাবকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁরা কেন মেয়ের বাল্যবিবাহ দিয়েছেন। এর উত্তরে অভিভাবকেরা করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং গ্রামাঞ্চলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে না পারায় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

অভিভাবকেরা যাতে মেয়েকে বোঝা মনে না করেন, তা উল্লেখ করে আবু সাঈদ মো. জুয়েল মিয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া মেয়েদের উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ারও সুপারিশ করেন।

আলোচনায় সেভ দ্য চিলড্রেনের সিনিয়র ম্যানেজার (অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইন) সামিয়া আহমেদ বলেন, করোনায় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ ছিল। করোনার প্রভাবে অনেক অভিভাবকের আয়–উপার্জনের পথও বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হন। অনেকে ছেলে সন্তানকে কাজে দিয়েছেন আর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এতে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ দুটোই বেড়ে যায় করোনার সময়।

সামিয়া আহমেদ বলেন, বিভিন্ন জরিপের তথ্য বলছে, একজন মানুষের খাবার লাগবে না বা পরিবার থেকে একজনের পেটে খাবার দিতে হবে না, মেয়ের বয়স বেড়ে গেলে যোগ্য পাত্র হাতছাড়া হয়ে যাবে, আর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার চেয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়া উত্তম—এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা থেকে অভিভাবকেরা মেয়ের বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন। মূল কথা মেয়ের বিয়ে দিয়ে অভিভাবকেরা দায়মুক্ত হতে চেয়েছেন। সামিয়া আহমেদ অভিভাবকের আয়–উপার্জনের পথ চালু রাখা এবং বাড়ির উঠানে শাকসবজি চাষ, হাঁস–মুরগি পালনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাড়ানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

গ্রামাঞ্চলের অনেক কাজি জন্মনিবন্ধনটি ভুয়া কি না, তা পরীক্ষা করতে পারছেন না বলে উল্লেখ করেন ঢাকা জেলার বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির সভাপতি মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ। তিনি ভুয়া জন্মনিবন্ধনসহ হয়রানি প্রতিরোধে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে একটি ‘ইউনিক আইডি’ চালু করার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, শিশুর ওই ইউনিক আইডিটি দিয়েই জন্মনিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট করলে কেউ আর ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতে পারবে না। প্রতি পদে হয়রানিও কমবে।

সঞ্চালকের বক্তব্যে আনিসুল হক বলেন, বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। শিশু বয়সেই সন্তানের মা হতে বাধ্য হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ছে তারা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকেও ছিটকে পড়ছে। তাই বাল্যবিবাহকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতেই হবে। আর এ জন্য সচেতনতা সৃষ্টি এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি।