করোনাকালে ঈদ ভাবনা : বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটছে

বিশ্বের প্রায় কম বেশি সব দেশেই চলছে করোনার তাণ্ডব; বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। মৃত্যু নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যত ব্যাপার পাওয়া যায়, এর মধ্যে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুভাবনা সবচেয়ে বেশি ভাবনায় ফেলে আমাকে। মৃত্যু অবধারিত, অপ্রতিরোধ্য ও প্রকাশ্য। করোনাঘাতের আগে মানুষের যে মৃত্যু হতো না তা কিন্তু নয়। কিন্তু সবকিছুর স্বাভাবিকতা আমরা প্রত্যাশা করি। আমরা একটা আয়োজনের জন্য অপেক্ষা করি। আকস্মিক যে মৃত্যু তা আমাদের বেদনা বাড়ায়। আমার কাছে মনে হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারই আসলে মৃত্যু। একদিন আজকে যে মৃত্যুর মিছিল চলছে, তা থেমে যাবে। মৃত্যু কিন্তু থেকে যাবে, তার আয়োজন ও স্বাভাবিকতা আমাদের কামনায় লুকিয়ে থাকবে হয়তো। করোনা থামার পর যারা বেঁচে থাকবেন, তাদের করোনামুক্ত পৃথিবীতে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে। মানুষ মারা গেলেও বেঁচে থাকবে মানব ও মানবতা। আমাদের সাধ্যমতো যা করার, যাদের জন্য করার, তা করতে হবে এখন। করোনার কারণে মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিকে আবার জাগাতে এবং বর্তমান আর্থ-সামাজিক জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে আমাদের শুধু সচেতন থাকলেই হবে না; করতে হবে আরও অনেক কিছু।

করোনায় ধাক্কায় বেশিরভাগ মানুষ জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। উদাহরণ হিসেবে শুধু প্রবাসীদের কথা একটু বলি। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের করা জরিপের কথা খবরের কাগজে পড়লাম। বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে দেশে ফেরা প্রবাসীরা বর্তমানে ভয়াবহ অসহায় হয়ে পড়েছেন। আয়ের কোনো উৎস নেই দেশে ফেরা ৮৭ শতাংশ প্রবাসীর। দেশে ফিরে সরকারি বা বেসরকারি কোনো সাহায্য পাননি ৯১ শতাংশ প্রবাসী। আর জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন ৫২ শতাংশ প্রবাসীর। 'বিদেশফেরত অভিবাসী কর্মীদের জীবন ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব' শীর্ষক জরিপের তথ্য এগুলো। ফিরে আসা এসব প্রবাসীদের একটা অংশের নিজেদের সঞ্চয় বলতে তেমন কিছু নেই। তাদের যে সঞ্চয় আছে, তা দিয়ে আরও কয়েক মাস হয়তো চলবে। তারপর কী হবে? বলা যায়, করোনার কার্যকরি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন এবং বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অন্য দেশগুলো আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রাখতে পারে। ফলে বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা বর্তমানে অনেকটা দৃশ্যমান। তাই এই প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর কাজটি শুধু সরকারের একার নয়। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সবাই মিলে এর সমাধান বের করতে হবে।

পৃথিবীতে শেষবার মহামারি হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। গুটি বসন্তের এই মহামারিতে ভারতে হাজারো লোকের মৃত্যু হয়েছিল। সে বছর সেই মহামারি নিয়ে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর প্রদেশ এবং বিহারে এক লাখ দশ হাজার মানুষ গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেখানে মারা গিয়েছিল ২০ হাজারের মত মানুষ। আমরা জানি, আক্রান্ত রোগীদের একেবারে বিচ্ছিন্ন করে সেই মহামারি সামাল দেওয়া হয়েছিল। গুটি বসন্তের সেই মহামারি ঠেকাতে নজিরবিহীন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এক কোটি গুটি বসন্তের টিকা দেওয়া হয়েছিল। ১০ লাখ সুঁই ব্যবহার করা হয়েছিল। ছয় লক্ষ গ্রামের ১২ কোটি বাড়িতে গিয়ে গিয়ে গুটি বসন্তের রোগীর সন্ধান করা হয়েছিল। তার জন্য সময়ও লেগেছিল। আজকে যে করোনা মহামারি, সেটিও একদিন থাকবে না।

করোনার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় সব দেশেই লকডাউন চলছে। এর প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ধেয়ে আসছে মহামন্দা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই মহামন্দার মাত্রা ১৯২০ সালের মহামন্দার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর সরকার প্রধানদের কপালে দুশ্চিন্তার কালো ছাপ স্পষ্ট হচ্ছে দিন দিন। এটা যতটা করোনা আক্রান্তের সংখ্যার এবং এর ফলে মৃত্যুহারের জন্য, ঠিক ততটাই অর্থনীতিতে মহামন্দার আশঙ্কা নিয়ে। আর শক্তিশালী দেশগুলো যেখানে ভবিষ্যতের অর্থনীতি নিয়ে চিন্তিত, সেখানে আমাদের মতো নিম্ন মধ্য আয়ের দেশের অর্থনীতির কী হবে তা বোঝাই যাচ্ছে। লকডাউনের কারণে কৃষি উৎপাদন ছাড়া পুরো অর্থনীতি আজ অবরুদ্ধ। এর ফলে একদিকে যেমন অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া কয়েক কোটি মানুষের আহারের চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে করোনা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে দুই-এক বছরের মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবুও যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশের সরকার অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে ইতোমধ্যে বড় অঙ্কের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ সরকারও বড় অঙ্কের (প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা) প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্যাকেজ অর্থনীতিতে কতটুকু গতি ফিরিয়ে আনতে পারবে তা একদিকে নির্ভর করবে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি মোট ক্ষতির পরিমাণের ওপর। অন্যদিকে, তা নির্ভর করবে প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ওপর।

বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর নিম্নমুখি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। শিল্পখাতে, বিশেষ করে উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে ক্ষতির মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ খাতে প্রতিদিনের অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক ক্ষতি সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে সেবাখাতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বেচা-কেনা এবং জরুরি সেবা ব্যতীত এই খাত মূলত অবরুদ্ধ। সব ধরনের যোগাযোগ (সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশপথ), পর্যটন, হোটেল ও রেস্তোরা, আবাসনসহ সকল প্রকার সেবা একেবারেই বন্ধ। স্বাস্থ্যখাতের বেসরকারি অংশটিতেও এক প্রকার অচল অবস্থা বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে সেবাখাতে প্রতিদিনের অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা।

আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা এ বছর তা অর্জন সম্ভব হবে না। ফলে আমরা সবাই কমবেশি ভুগব। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক। হাটবাজারে ছোট পানের দোকান, নানা ধরনের পণ্য বিক্রি করে এদের জীবন চলে। যদি মাসের পর মাস মানুষ ঘর থেকে বের হতে না পারেন, তাহলে তারা কীভাবে পরিবারের সবার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন? কী ঘটবে গৃহকর্মীদের, যদি সংক্রমণ রোধে তাঁদের বাসায় ঢুকতে দেওয়া না হয়?

দেশে 'দিন আনে দিন খায়' মানুষেরা সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। ঢাকা শহরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়ায় আমরা দেখছি মধ্যবিত্তরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস স্টক করতে, আর খেটে খাওয়া মানুষদের দেখছি আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার চিন্তায় অস্থির হতে। ভাবতে হবে, রিকশাওলার সংসার কীভাবে চলবে যদি তার প্রতিদিনের আয় বন্ধ হয়ে যায়? বাস চলাচল এখন বন্ধ, পরিবহনশ্রমিকেরা তাহলে কীভাবে তাদের সংসারের খরচ চালাবেন?

সরকার স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা করছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সেটার ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু না হলে এর লাভ থেকে বঞ্চিত হবে যাদের আসলে সহায়তার দরকার তারাই। পাশাপাশি শুধু রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে না থেকে সামর্থ্যবান সবাইকে নিজেদের অবস্থান থেকেও দায়িত্ব নিতে হবে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলা করা আমাদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এটা যেমন সত্যি, তেমনি আজকের পরিস্থিতিতে আমাদের ভিন্নভাবে কাজ করার একটা সুযোগও কিন্তু তৈরি করেছে। এ ধরনের বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুতির ঘাটতিগুলো এখন আমরা বুঝতে পারছি। এ ধরনের সংকট সামনে আরও আসবে, বিশেষজ্ঞরা এ রকম মতামতই দিচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে ভিন্ন ধরনের। দুর্যোগে কিংবা মহামারির ঝুঁকিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিয়ে আগাম ভাবনার সময় এসেছে।

এই মহামারির সময় ঈদ এলো। ঈদ যে রূপে আমরা দেখেছি এর আগে, আজকের ঈদ সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এসেছে। এখন অনেকের ঘরে খাবার নেই। চাকরি হারাচ্ছেন কেউ কেউ। এসবের মধ্যে ঈদ কখনও আনন্দের হতে পারে না। তবুও এই ঈদকে আমরা সার্থক করতে পারি। সেটি কীভাবে? এই দুর্যোগে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি ভালোবাসা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। সেটা হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। হতে পারে ব্যক্তি উদ্যোগে। করোনাকালের এই ঈদে আমাদের আনন্দটুকু ভাগাভাগি করে নিতে পারি। আর যদি আমাদের আশেপাশে থাকা মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারি, তাহলেই দেখব ঈদটা এই মলিন সময়ে কিছুটা হলেও আনন্দের হবে।

শুরু করেছিলাম জীবনানন্দ দাশের কথা দিয়ে। শেষও করছি তার রচিত কয়েক লাইন দিয়ে,
'তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ রবে না আর, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন:
সেই মুখ আর আমি র'বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।'

*লেখক: তরুণ কবি