করোনাকালে ভালোবেসে হাত বাড়ালেন তাঁরা

মার্চের ৮ তারিখে দেশে তিন ব্যক্তির শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। আর প্রথম মৃত্যু ১৮ তারিখে। এরপর ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় টানা সাধারণ ছুটি। এই সময়ে আয় না থাকায় সংকটে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ। অন্যদিকে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার ও প্লাজমা সংগ্রহে হিমশিম খেতে হয় সাধারণ মানুষকে। করোনায় মৃত ব্যক্তিদের দাফন নিয়ে বিপাকে পড়েন স্বজনেরা। এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে কিছু মানুষ মানুষকে ভালোবেসে এগিয়ে এসেছেন, সহমর্মিতার হাত বাড়িয়েছেন। তাঁদের কর্মকাণ্ড সাহস দিয়েছে বিপদগ্রস্ত মানুষকে।

সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময়ে যে যতটুকু পেরেছেন, মানবিক সহায়তা করার চেষ্টা করেছেন। এই সময়ে অনেকে কাজ হারিয়েছেন, এখন তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যাঁদের সহায়তা প্রয়োজন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো গেলে সংকট কাটানো সহজ হবে।

অনন্য কাউন্সিলর মাকসুদুল

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার ওরফে খোরশেদ আলোচনায় আসেন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ দাফন ও সৎকার করে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মরদেহ দাফনে স্বজনেরা কেউ এগিয়ে না এলেও তিনি ও তাঁর স্বেচ্ছাসেবক দল ১৪৫টি লাশ দাফন ও সৎকার করেছে।

মাকসুদুল বলেন, ‘যখন দেখলাম করোনায় মারা যাওয়া মরদেহগুলোর পাশে কেউ নেই, তখন মনে হলো আমারও তো এই দশা হতে পারে। “মৃতদেহের স্বজন আমরা” স্লোগান নিয়ে লাশ দাফন শুরু করি।’ মাকসুদুল বলেন, প্লাজমা সংগ্রহ, অক্সিজেন ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা ছাড়াও করোনা-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য সেলাই মেশিন, হুইলচেয়ার, সাইকেল বিতরণের কাজও করছেন।

আয় না থাকায় সংকটে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ। অন্যদিকে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার ও প্লাজমা সংগ্রহে হিমশিম খেতে হয় সাধারণ মানুষকে। করোনায় মৃত ব্যক্তিদের দাফন নিয়ে বিপাকে পড়েন স্বজনেরা। এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে কিছু মানুষ মানুষকে ভালোবেসে এগিয়ে এসেছেন, সহমর্মিতার হাত বাড়িয়েছেন। তাঁদের কর্মকাণ্ড সাহস দিয়েছে বিপদগ্রস্ত মানুষকে।

লাশ দাফনের স্বেচ্ছাসেবীরা
শুরুর দিকে করোনা বা করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর পর সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে মরদেহ দাফন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। তখন এগিয়ে আসে কিছু প্রতিষ্ঠান। যাদের হয়ে কাজ করছেন শত শত স্বেচ্ছাসেবী।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত আল মারকাজুল ইসলামী, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, রহমতে আলম ফাউন্ডেশন ও আল রশীদ ফাউন্ডেশন লাশ দাফনের কাজ করছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. সাইফুল্লাহিল আজম বলেন, এখন পর্যন্ত ঢাকায় চারটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে ৬ হাজার ৭৭৯টি মরদেহ দাফন ও সৎকার করা হয়েছে।

ডাকসুর তানভীরের ১২১ দিন
খেটে খাওয়া মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে নিজের জমানো ১৩ হাজার টাকা নিয়ে কাজে নামেন তানভীর হাসান সৈকত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সদস্য তানভীর। তানভীর ছাত্রলীগেরও সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা৷

তানভীর হাসান বলেন, ‘কাজটি শুরু করেছিলাম একা। ফেসবুকের পোস্ট ও প্রতিদিনের কার্যক্রম দেখে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। অনেকে শারীরিক শ্রমও দিয়েছেন। টানা ১২১ দিন খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল।’

তাঁরা করেছেন ‘অক্সিজেন ব্যাংক’
করোনা রোগীদের শ্বাসকষ্টের যন্ত্রণা দূর করতে কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছেন ‘অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যাংক’। অজ্ঞাত রোগীর বন্ধুখ্যাত সাইফুল ইসলাম নেসার মাত্র একটি সিলিন্ডার নিয়ে চট্টগ্রামে শুরু করেন এ কার্যক্রম। বর্তমানে ১৮টি জেলায় কার্যক্রম চলমান। ব্যাংকের কাছে এখন ৫০০ সিলিন্ডার রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা সেবা পাচ্ছে মানুষ। স্বেচ্ছাসেবকেরা বাসায় বাসায় পৌঁছে দিচ্ছেন সিলিন্ডার।

করোনার সময়ে যে যতটুকু পেরেছেন, মানবিক সহায়তা করার চেষ্টা করেছেন। এই সময়ে অনেকে কাজ হারিয়েছেন, এখন তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যাঁদের সহায়তা প্রয়োজন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো গেলে সংকট কাটানো সহজ হবে।
অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন, সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বহুমুখী উদ্যোগ ছিল চিকিৎসক মনীষার
মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বরিশালবাসীর কাছে আগে থেকেই সুপরিচিত মনীষা চক্রবর্তী। করোনার শুরু থেকেই সচেতনতা, খাদ্য ও পণ্যসহায়তা, চিকিৎসা, অ্যাম্বুলেন্স সুবিধাসহ বহুমুখী কাজ শুরু করেন চিকিৎসক মনীষা।

‘এক মুঠো চাল’ কর্মসূচির আওতায় প্রতিদিন ২০০ পরিবারকে চাল, ডাল, আলু ও তেল দিয়ে সহায়তা করেন। করোনায় জরুরি রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য প্রথমে ১০টি ব্যাটারিচালিত তিন চাকার অটোরিকশাকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করেন। পরে একটি অ্যাম্বুলেন্স সংগ্রহ করে রোগী পরিবহন করেন।

মনীষা বলেন, ‘মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে এমন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। সীমিত সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করেছি মানুষের পাশে থাকতে। দেশ-বিদেশ থেকে সামর্থ্যবান ও মানবিক ব্যক্তিরা আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।’

পিপিই থেকে চাকরি, পাশে ছিল সংযোগ
মার্চের শুরুর দিকের কথা। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জামের (পিপিই) অভাবে স্বাস্থ্যকর্মীরা ছিলেন ঝুঁকিতে। এই সংকট থেকেই যাত্রা শুরু ‘সংযোগ: কানেকটিং পিপল’ ফেসবুক গ্রুপের। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একদল সাবেক শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার তরুণ গড়ে তোলেন সংযোগ। এর উদ্যোক্তা আহমেদ জাবেদ জামাল বলেন, দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়াই তাঁদের প্রধান কাজ। পিপিই সরবরাহ, খাদ্যসহায়তা, অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া, প্লাজমা সংগ্রহ, বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরির মতো কাজ করে যাচ্ছে গ্রুপটি।