করোনাকালে ১০৯৮ নম্বরে শিশুদের কল এসেছে দ্বিগুণ

আগের বছরের তুলনায় করোনাকালে দ্বিগুণেরও বেশি কল এসেছে শিশুদের সহায়তায় স্থাপিত চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এ। টোল ফ্রি এই নম্বরে ২০২০ সালে দিনে গড়ে কল এসেছে ৫৪১টি। এসব কলের মধ্যে করোনাসংক্রান্ত তথ্য, আইনি সহায়তা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, সহিংসতার শিকার হওয়া, স্কুল, পড়াশোনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কল বেড়েছে ২ থেকে ১৩ গুণ। আগের বছরটিতে দিনে কল আসত ২৬০টির বেশি।

অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক জানতে চেয়েছেন, স্কুল কবে খুলবে, ইন্টারনেট সহজলভ্যতা নে,ই কীভাবে অনলাইনে ক্লাস করবে? কোনো কোনো প্রেমিক বা প্রেমিকা সম্পর্কের অবনতি ও এ নিয়ে মানসিক পীড়ন হওয়ার কথা জানিয়ে সাহায্য চেয়েছে। বাল্যবিবাহ বন্ধের কলও এসেছে উল্লেখযোগ্য হারে।

প্রথম আলোকে দেওয়া চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮–এর তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে মোট কল এসেছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৮৪টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তথ্য জানতে চেয়ে কল এসেছে ১২ হাজার ৪৯টি। ২০১৯ সালে মোট কলের সংখ্যা ছিল ৯৬ হাজার ২০৫। আর এ বছরের প্রথম তিন মাসে মোট কল এসেছে ২৬ হাজার ১০৮টি।

চাইল্ড হেল্পলাইনের সমন্বয়ক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন প্রথম আলোকে বলেন, কল এজেন্ট প্রত্যেকেই কাউন্সেলর। তবে কোনো শিশুর ক্ষেত্রে মানসিক ট্রমা গুরুতর হলে তার কল মনঃসামাজিক কাউন্সেলরের কাছে স্থানান্তর করা হয়। প্রত্যন্ত এলাকার কল পেয়ে শিশুদের জন্য সাড়া দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নেতৃত্বে পুলিশ, সমাজসেবা কর্মকর্তা, সমাজকর্মী ও এনজিওগুলো নিয়ে ভ্রাম্যমাণ দল রয়েছে। তিনি জানান, করোনাকালে তথ্যবিষয়ক কল অনেক বেশি এসেছে। অনেকে জানতে চেয়েছেন, শিশুর টিকা কোথায় গিয়ে দেবেন, করোনা মোকাবিলায় শিশুদের কোনো টিকা আছে কি না, অসুস্থ হলে কোথায় যাবেন ইত্যাদি।

২০১১ সালে চাইল্ড হেল্পলাইন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে ঢাকায় পাইলট প্রকল্প আকারে কাজ শুরু করে। ২০১৫ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরে সারা দেশের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে কল সেন্টার স্থাপন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০৯৮ নম্বরটিকে টোল ফ্রি ঘোষণা করে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ভারত ও নেপালেও এই নম্বরই শিশুদের সহায়তায় ব্যবহার হয়। ইউনিসেফ বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের (সিএসপিবি) আওতায় চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ পরিচালিত হয়। মোট জনবলের মধ্যে ২৭ জন কল এজেন্ট এবং ১০ জন মনঃসামাজিক কাউন্সেলর রয়েছেন।

১১-১৪ বছর বয়সী বেশি কল করে

চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮–এর ফেসবুক পেজ থেকে জানা যায়, জন্ম নিবন্ধন অনুসারে বয়স বেশি জানিয়ে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসএসি) পরীক্ষার জন্য নিবন্ধনে বাধা দেওয়া হয় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রকে। ১০৯৮–এ ফোন করে শিশুটি এ ব্যাপারে সাহায্য চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদ সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই ছাত্রের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়। হারিয়ে যাওয়া এক শিশুকে পাবনা থেকে পৌঁছে দেওয়া হয় ময়মনসিংহে পরিবারের কাছে। এক বাবা ১০৯৮–এ ফোন করে কিশোরী মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ের নবজাতক সন্তানকে উদ্ধার করাতে সক্ষম হন। ধর্ষণের শিকার শিশুর সহায়তা, প্রেমিকের সঙ্গে বাসা ছেড়ে যাওয়া কিশোরী এবং কাজের জায়গায় আটকে রাখা কিশোরীকে উদ্ধার ইত্যাদি সফলতার গল্প রয়েছে ফেসবুক পেজটিতে।

হেল্পলাইন জানিয়েছে, ১৫ শতাংশ কল আসে ১০ বছরের কম বয়সী, ৩৫ শতাংশ কল ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী, ২৭ শতাংশ কল ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী এবং ২৩ শতাংশ কল আসে ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের কাছ থেকে। মোট কলের ৬৫ শতাংশ করে পুরুষ ও ৩৫ শতাংশ নারী।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জাহেরীন প্রথম আলোকে বলেন, ১০৯৮–এর জন্য মাঠপর্যায়ে আলাদা কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। থানায় শিশুবিষয়ক কর্মকর্তাকে একই সঙ্গে অনেক কাজ করতে হয়। ফলে, প্রয়োজনের সময় অনেক ক্ষেত্রেই তাঁকে পাওয়া যায় না। সমাজসেবা কর্মকর্তারও ঘাটতি রয়েছে। ফলে, কল পেয়েও আশানুরূপ সাড়া দেওয়া যায় না।

হাজার হাজার ‘প্র্যাংক’ ও ‘সাইলেন্ট’ কল

১০৯৮ নম্বরে নিছক মজা করার জন্য কল আসে প্রচুর। এগুলোকে ‘প্র্যাংক কল’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ১১ হাজার ৪৮২, ২০২০ সালে ১৩ হাজার ২৭৭ এবং এ বছরের প্রথম তিন মাসে ৩ হাজার ৩৩৫টি প্র্যাংক কল এসেছে।
এ ব্যাপারে চাইল্ড হেল্পলাইনের সমন্বয়ক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুদের অনেক সময় নিজের কথা বলার জায়গা থাকে না। এ নম্বরে অনেক শিশু ছড়া বলে, গল্প বলে। এটাকে আমরা উৎসাহিত করি।’

কল করে কিছু না বলে নীরব থাকে—এমন ‘সাইলেন্ট কল’ এসেছে ২০১৯ সালে ১০ হাজার ৩২৪, ২০২০ সালে ১২ হাজার ৪২৭ এবং এ বছরের প্রথম তিন মাসে ৯ হাজার ৫৪টি।

২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত কল আসার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০টি জেলা হচ্ছে ঢাকা, ভোলা, কুড়িগ্রাম, খুলনা, নীলফামারী, রংপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, গাজীপুর ও কক্সবাজার। ঢাকা জেলা থেকে মোট কল এসেছে ৭৪ হাজার ৭৫২টি।

১০৯৮ নিয়ে প্রচার বাড়ানোর ওপর তাগিদ দিয়েছেন শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদ। প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের সুরক্ষার জন্য চাইল্ড হেল্পলাইন অত্যন্ত জরুরি। তবে বেশির ভাগ মানুষই এই নম্বর সম্পর্কে জানে না। ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা নিলে অনেক শিশুকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। অনেকে শিশুর ওপর নির্যাতন হতে দেখলে বিনা খরচে এই নম্বরে ফোন করে সাহায্য চাইতে পারবেন।