করোনাযুদ্ধে অন্য রকম এক যোদ্ধা সাদিকুল

ছবি সংগৃহীত
ছবি সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকায় করোনাভইরাসের কারণে অনেক এলাকায় লকডাউনে ঘরবন্দী অগণিত মানুষ। অনেকে নিত্যপণ্য যাওবা কয়েক দিনের জন্য কিনে রেখেছিলেন, এখন সেসবের ফের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য ঘরের বাইরে পা দেওয়াই তো বিপদ। এসব ঘরবন্দী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থী সাদিকুল ইসলাম। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষ শিক্ষা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সাদিকুল। রাজধানীর ঘরবন্দী মানুষের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। ত্রাণ কার্যক্রমসহ বিভিন্ন উদ্যোগে তাঁর সংগঠন বৃহন্নলার হিজড়া সদস্যরা অংশ নিচ্ছেন।

আজ শুক্রবার সকালে টেলিফোনে সাদিকুল বললেন, 'এক বাসার সদস্যরা ঘর থেকে বের হতে চাইছেন না, আবার রমজানও শুরু হচ্ছে। তাই বাজার করে ওই বাসার গেটের বাইরে দিয়ে আসব, তাই এখন বাজারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।'

শুধু বাজার নয়, কেউ হয়তো দরিদ্র মানুষকে রান্না করা খাবার দিতে চাইছেন, কিন্তু ঘরে ওয়ানটাইম বা একবার ব্যবহারের জন্য যে বক্স তা নেই, আবার খাবার পৌঁছে দিতেও ঘরের বাইরে যেতে চাইছেন না, তখন ডাক পড়ে সাদিকুলের। তিনি বক্স কিনে দিয়ে আসেন, আবার প্যাকেট করা খাবারগুলোও বিতরণ করে দেন। কারও নামে আসা পার্সেল পৌঁছে দেওয়া, কেউ কারও কাছে কিছু পাঠাতে চাইলে তা দিয়ে আসা, এসব করছেন তিনি। এভাবে ঘরবন্দী মানুষের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করছেন তিনি। ১৪ এপ্রিল থেকে তিনি এভাবেই কাজ করছেন।

ছবি সংগৃহীত
ছবি সংগৃহীত

সাদিকুল বললেন, 'কাজের জন্য অনেকে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেন, আবার অনেকে বাজার বা অন্য কিছু কিনে পৌঁছে দেওয়ার পরও টাকাটা দিচ্ছেন। আমি পৌঁছে দেওয়ার এ কাজের জন্য কোনো টাকা নিই না। তবে পরিচিত বা অনেকেই মূল টাকার সঙ্গে কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে দেন বা বাসার গেটে গেলে আমার জন্য কিছু খাবার দিয়ে দেন। আমি বরাবরই বলছি, আমি কোনো কিছুর বিনিময়ে কাজটা করছি না, শুধু দেশের এই পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে থাকতে চাইছি। তবে আমি যেহেতু সাইকেল চালিয়ে কাজটা করি, তাই এক বোতল হালকা ঠান্ডা পানি আর এক টুকরো হাসি চাই সবার কাছে।'

সাদিকুল ইসলাম হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গঠিত উদ্যোগ বৃহন্নলা'র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। করোনাভাইরাস বিস্তারের পর হিজড়া জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছেন।
সাদিকুল বললেন, 'আমাদের তেমন কোনো সামর্থ্য নেই, তাই খুব বেশি ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত করতে পারিনি। হিজড়া জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ত্রাণ বিতরণ করা হয়। অর্থের অভাবে বর্তমানে ত্রাণ বিতরণ সেভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে মাঠে যখন নেমেছি, তাই আর ঘরে ফিরে যাইনি। এখন ঘরবন্দী মানুষের বিভিন্ন চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছি। এ কাজেও বিভিন্ন এলাকার হিজড়া সদস্যরা প্রস্তুত আছেন। আর আমি যেহেতু সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন কাজ করছি, তাই আমার পক্ষে পুরো রাজধানী বা বৃহৎ আকারে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, দক্ষিণ বাড্ডা বা যেসব জায়গা থেকে ফোন পাচ্ছি সে সব এলাকায় গিয়ে কাজ করে দিয়ে আসছি। ফেসবুকে আমার টেলিফোন নম্বর (০১৯৮০৭০৪৩৯৬) ও ই–মেইল ([email protected]) দেওয়া আছে।'

সাদিকুল সকাল ৯ টা থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত রাজধানীর শাহবাগ, নিউমার্কেট, আজিমপুর, পলাশী, বকশিবাজার, চাংখারপুল এবং দক্ষিন বাড্ডা এলাকায় মূলত মানুষের বাজার করা, ওষুধ কেনা ও জরুরি পার্সেল পৌছে দেওয়ার কাজ করছেন । জানালেন, অতি জরুরি কাজেও যাতে কাউকে ঘর থেকে বের হতে না হয়, সে জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সাদিকুলের বর্তমান কাজ এবং বৃহন্নলার কাজে সার্বিক সহযোগিতা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, বর্তমান শিক্ষার্থী ও বেশ কয়েকজন শিক্ষক। বৃহন্নলার সদস্যরা শাহজাদপুর বস্তি এলাকায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ, সায়দাবাদ, যাত্রবাড়ি, পলাশী, আজিমপুর, চাঁনখার পুল, ঢাকা মেডিকেল এলাকায় গণপরিবহনে, ঘনবসতিপূর্ণ জেনেভা ক্যাম্প এলাকায়, অ্যাম্বুলেন্সে জীবাণুনাশক স্প্রে করা, মানুষকে সচেতন করা, কমলাপুর বস্তিতে ত্রাণসামগ্রী বিতরণসহ নানা কাজ করেছেন।

সাদিকুল জানালেন, বৃহন্নলা ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ, প্রবেশগম্য পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছে সংগঠনটি।
সাদিকুল বললেন, হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে একটি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে কাজের শুরু। সে প্রতিযােগিতা থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই কাজ শুরু হয়। হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা একশন এইড বাংলাদেশ, বেসরকারি সংগঠন উত্তরণ ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনও বর্তমানে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বৃহন্নলার জন্য আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাওয়া যায়নি, করোনাভাইরাসের বিস্তারে কাজটি আরও পিছিয়ে গেছে। সাদিকুল তাঁর শিক্ষার অংশ হিসেবে হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়েই থিসিস করছেন।

সাদিকুল বললেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে সমাজে নেতিবাচক মনোভাব আছে। তবে দেশের এই সময়ে হিজড়ারা মানুষের জন্য এগিয়ে এসেছে এবং হিজড়ারা ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন কাজে অংশ নিচ্ছে, তা সাধারণ মানুষও খুব সহজে গ্রহণ করেছে। হিজড়াদের অনেকেই জানিয়ে রেখেছেন, তাঁরা যে কোনো কাজে অংশ নিতে প্রস্তুত।

মাদারীপুরের ছেলে সাদিকুল। তাঁরা তিন ভাই। বাবা ব্যবসা করেন। বলেলন, 'হিজড়াদের নিয়ে কাজ করব, তা পরিবার প্রথমে একদমই মেনে নিতে পারেনি। কয়েক মাস পর্যন্ত আমার সঙ্গে কথা বলেনি পরিবারের সদস্যরা। তবে এখন মেনে নিয়েছে। করোনাভাইরাসের বিস্তারের সময় বাড়িতে না থেকে পথে পথে কাজ করছি, তা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের উদ্বেগ তো আছেই। ফােন করলেই মা কান্নাকাটি করেন। নিজেদের পরিবারেও নানা সমস্যা আছে। বাবা জানিয়েছেন, ধান কাটার জন্য শ্রমিক পাচ্ছেন না, তাই সুযোগ পেলে যেন বাড়ি যাই। সারা দিন পরিশ্রমের পর নিজের শরীরও ক্লান্ত লাগে। দীর্ঘমেয়াদি করোনার স্থায়ী সমাধান নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। আবার মানুষের একটু হাসিমুখ দেখার জন্য আবার কাজে নেমে পড়ি।'

সাদিকুল বললেন, তাঁর এ কাজে তিনি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন, সবার নাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়, আবার যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরাও নাম প্রকাশ করতে চান না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের এক নারী স্বেচ্ছাসেবকসহ সাদিকুল সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সাদিকুলের নিজের সুরক্ষায় বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাসহ হিজড়া সদস্যদের সুরক্ষাতেও এগিয়ে এসেছেন অনেকে। তিনি বললেন, '২২ মার্চ বাড্ডা এলাকার বিভিন্ন বাড়ির গেটে পোস্টার লাগানোর কাজে এগিয়ে আসেন কলেজের এক বন্ধু। লকডাউনে এই বন্ধুর বাড়িতেই আমি থাকছি। নিজেরা দূরত্ব বজায় রেখে চলি। ঘর সবসময় জীবাণুমুক্ত রাখি। এক ধরনের কোয়ারিন্টিনেই আছি। বাসায় ফিরে রান্না করে খাওয়া, ব্যবহার করা কাপড় ধোয়া, সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে পড়াশোনায় মন বসছে না। দুই বন্ধু আছি বলে কাজের সময় বাদে বাকি সময়গুলো গল্প করে, বিভিন্ন ডকুমেটারি দেখে কাটাই।'

সাদিকুল দৃঢ়ভাবেই বললেন, 'ঝুঁকি নিয়ে যেহেতু একবার ঘর থেকে বের হয়েছি, সুস্থ থাকলে দেশ করোনামুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে চাই।'