করোনাযুদ্ধে অদম্য সেনানী নারী

প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করছি। আমার বোন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অনলাইন ক্লাস, মিটিং—এসবের পাশাপাশি করোনাকালীন কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া গৃহকর্মে মূল দায়িত্ব নেওয়া সেনানী। গৃহকর্মের সহযোগীকে দুই মাসের অগ্রিম বেতন দিয়ে ছুটি দেওয়া হয়েছে সঙ্গনিরোধের একেবারে প্রথম দিকেই।

চার কক্ষের একটা ফ্ল্যাটে আমাদের বাস। আমাদের গৃহের সাহায্যকর্মী একদিন পরপর ঘর মুছত। এখন প্রতিদিন দুই কি তিনবার। বাসায় বাজার ঢুকলে তো কথাই নেই। হাত ধোয়া, ব্যবহার্য জিনিস বারবার পরিষ্কার করা, জীবাণুনাশক ব্যবহার—সবই বেড়েছে। স্বাস্থ্যসচেতনতা আমার অপর্যাপ্ত, সেটা মানতে অসুবিধা নেই। মাঝেমধ্যে ঘরের বন্দিত্ব অবস্থায় হাঁপিয়ে উঠি। তারপর সারা দিন ঘরে থাকায় খাদ্য গ্রহণ তো বেড়েছেই। তার মানে খাদ্য প্রস্তুত থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি মানা—সবকিছুই কয়েক গুণ বেড়েছে। আমি শুধু সাহায্যকারী। মূল দায়িত্ব পালন করছে আমার কর্মজীবী বোনটিই। ইমিউনিটি বাড়াতে গেলে কী খেতে হবে, কী করতে হবে বা কী করতে হবে না—সব বিষয়ে জানা, মানা ও মানানোর কাজটা একাই কাঁধে নিয়েছে সে। আমার কিছুটা নির্ভার ও নিরাপদ বোধ করার পেছনে পুরো কৃতিত্বেই করোনাযুদ্ধে আমার গৃহের সেনাপতি এই নারীর।

ডা. আইরিন ফেরদৌস, ফরিদপুরের একটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক। সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে লড়ছেন ঘরে–বাইরে একাধারে। ঘরে দুজন শিশুসন্তান আছে যাদের সার্বিক খেয়াল রাখতে হয়। পরিবারের সব কাজের নিত্যকার সমন্বয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা পরিস্থিতিতে পরিবারের জন্য বাড়তি স্বাস্থ্য সতর্কতা। নিজের কাজের ঝুঁকির সঙ্গে পরিবার যাতে ঝুঁকিতে না পড়ে, তার জন্য মানতে হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা। মনকে দুর্বার কঠিন করে রাখতে হচ্ছে। অবুঝ শিশুরা তো আর মায়ের এই এড়িয়ে চলার অর্থ বোঝে না। অবর্ণনীয় সংগ্রাম ও মানসিক দৃঢ়তার সঙ্গে ঘরে–বাইরে সমানতালে করোনার বিরুদ্ধে লড়ছেন এমন অনেক সম্মুখ যোদ্ধা নারী।

কথা হচ্ছিল চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা জান্নাতুল আদনা ইসলামের সঙ্গে। ব্যাংকের কাজের সঙ্গে শিশুপুত্র ও বয়স্ক বাবা-মায়ের জন্য থাকছে বাড়তি সতর্কতা। তার মানে বাড়তি পরিশ্রম। একদিকে গৃহকর্ম, অন্যদিকে অফিসের কাজ সমানভাবে চালিয়েও একচুল ছাড় নেই পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে। নিজের চাইতে পরিবার নিয়েই বেশি ভাবনা। নিজেকে জীবাণুমুক্ত রাখা, পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিজেকে নিবেদন করে চলছেন আদনার মতো লাখো কর্মজীবী নারী।

গৃহবধূ অন্তরা দেব জানাচ্ছিলেন পরিবার নিয়ে সারাক্ষণের চিন্তার কথা। পরিবারের ভালো–মন্দ দেখার পুরো দায়িত্ব বরাবরের মতো সামলে গেলেও বলছিলেন, পরিচ্ছন্নতা ছাড়াও গৃহের কাজ অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা গৃহকর্মে সাহায্য করা শুরু করলেও তারা অতটা অভ্যস্ত নয়। আর এই পরিস্থিতিতে সব কাজই করতে হচ্ছে নিখুঁতভাবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে। তাই মানসিক চাপ ও দৈহিক পরিশ্রম—দুই–ই বেড়েছে সমানতালে। এ ছাড়া পরিবারের প্রায় সব সদস্যই সার্বক্ষণিক গৃহে অবস্থান করায় তাদের জন্য বারবার খাবার তৈরিসহ সার্বিক দেখাশোনার বাড়তি চাপ তো আছেই। এ ছাড়া অনেক দিন বাসায় থাকায় সবার মানসিকতায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যা সামলাতে হচ্ছে মূলত পরিবারের কেন্দ্র নারীদেরই। তিনি আরও জানান, শিশুরা মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়ছে বেশি। এত কাজের মধ্যেও ওদের মানসিক স্বাস্থ্যের যাতে ক্ষতি না হয়, তার জন্য বাড়তি নজর ও সময় দেওয়ার চ্যালেঞ্জও মা হিসেবে তাঁকে পালন করতে হয়।

একই ভাবনা ও অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি পাই গৃহবধূ হৈমন্তী বিশ্বাসের কথায়। বলছিলেন সারাক্ষণ পরিবার নিয়ে উদ্বিগ্নতার কথা। পুরো পরিবার নিয়ে চলে এসেছেন স্বামীর কর্মস্থলে। ব্যস্ততার কারণে স্বামী কতটা স্বাস্থ্যবিধি মানবেন, সেই চিন্তা থেকেই পাড়ি দেওয়া। এই মহামারিতে বাড়তি প্রস্তুতি নিয়ে করোনার থেকে পুরো পরিবারকে সুরক্ষার গুরুদায়িত্ব নিতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছেন নিজের কথা। তাঁর কাছে পরিবারই সব। পরিবারের সব সদস্য স্বাস্থ্যবিধি পালনে সমান সিরিয়াস নয়, তাই প্রয়োজনে কঠোর হয়েও পরিবারকে সুস্থ রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এমন কোটি কোটি পরিবারের প্রাণ নারীরা।

ব্যাংকার স্বামী ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন বাইরে, নিজে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে অনলাইনে চালিয়ে যাচ্ছেন সব কার্যক্রম। বাচ্চার দেখাশোনা, অফিসফেরত স্বামীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রয়োজন ও সুরক্ষা—সব সমানভাবে সামলাতে হচ্ছে রোখসানা রুমাকে। ক্লান্তির কথা এখনই ভাবতে নারাজ। বাঁচতে হবে সবাইকে নিয়েই। আর সেটা জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই। নিজের মনোবল শক্ত না থাকলে পরিবারের কী হবে? তাই ইস্পাতকঠিন শপথ নিয়েই এই যুদ্ধে শামিল রুমার মতো অনেক নারী।

হ্যাঁ, একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যাচ্ছি আমরা। অচেনা, অদেখা আর মারণঘাতী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছি আমরা। একেকজন একেকভাবে লড়ছেন। এককভাবে লড়ছেন, আবার কখনো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ বা পেশা এখানে বিবেচ্য না হলেও কারও কারও লড়াইটা একটু ভিন্ন।

ব্যক্তির সুরক্ষার কেন্দ্রস্থল যখন গৃহ, তখন পরিবারকে সুরক্ষা দিতে প্রয়োজন মানসিক দৃঢ়তা, দক্ষতা, সাবধানতা, কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা ও উচ্চমাত্রার সেক্রিফাইস। আর এই গুণাবলি নিয়ে এই যুদ্ধটায় নেতৃত্বের আসনে আমাদের নারীরাই। নারীরা কর্মক্ষেত্রের মতোই সমানতালে ফ্রন্টলাইনারের ভূমিকায় নিজ গৃহেও। পরিবারের প্রতি তাঁদের একাগ্রতা, আত্মনিবেদন ও উৎসর্গের অতিমানবীয় ক্ষমতা করোনার যুদ্ধে আমাদের জয়ের পথ দেখাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় তাঁদের এই নিবেদনকে কখনো কখনো বাড়াবাড়ি হিসেবেও ভুল বুঝছে কেউ কেউ। যেটা তাঁদের অজ্ঞতারও বহিঃপ্রকাশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতার বদলে ভাগ্যে মিলছে নির্যাতনও। কিন্তু সময় এসেছে স্বীকৃতির। একটু উৎসাহ পেলে আমাদের নারীরা অজেয়। আমাদের জয়তীরা করোনার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধেও সেনানায়ক হয়ে অজেয় থাকুক। বেঁচে যাক মানুষ, মানবতা, দেশ আর ব্রহ্মাণ্ড। কৃতজ্ঞতা আমাদের মাতৃরূপী নারীদের প্রতি।

* শিক্ষক: ইংরেজি বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]