করোনার আকালে এখন সঞ্চয়ই তাঁদের ভরসা

মঙ্গলবার ছিল বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামুদ্দি ইউনিয়নের হলতা বাজারে হাটের দিন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে হাটে লোকজনের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। উপজেলার ট্রলারঘাটে।  ছবি: প্রথম আলো
মঙ্গলবার ছিল বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামুদ্দি ইউনিয়নের হলতা বাজারে হাটের দিন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে হাটে লোকজনের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। উপজেলার ট্রলারঘাটে। ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল নগর ছাড়িয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বাকেরগঞ্জ উপজেলার পাণ্ডব নদের তীরে কৃষ্ণকাঠি গ্রাম। সবুজ প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়ায় গ্রামটা এমনিতেই নির্জন। সেই নির্জনতাকে আরও গভীর করেছে করোনার আকাল। এই গ্রামের মঞ্জু রানীর (৩৫) কথায় সেই ইঙ্গিত পাওয়া গেল।

নদের তীরে সরু মেঠোপথটা পশ্চিমে অনেক দূর গেছে। কিছুদূর এগোতেই দেখা গেল, মঞ্জু রানী গোবর ঘুঁটে জ্বালানি তৈরি করছিলেন। কুশল জানতে চাইলে তিনি স্মিত হেসে বললেন, ‘এই তো আছি।’ পাশেই তাঁর বাড়ির চারপাশে দারিদ্র্যের মলিন চেহারা। ছোট্ট টিনের দোচালা ঘরটার চারপাশে হোগলপাতার বেড়া। স্বামী সঞ্জয় চন্দ্র শারীরিক প্রতিবন্ধী। এ জন্য চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছয়জনের সংসার মঞ্জু রানীকেই সামলাতে হয়।

গ্রামের বিল-বাদাড়ে ঘুরে শাকসবজি, কলা, দেশি ফল সংগ্রহ করে পাশেই সুখী নীলগঞ্জ বাজার কিংবা নদীপথের দূরত্বে হলতা বাজারে বিক্রি করে এত দিন তিন–চার শ টাকা আয় হতো। এ দিয়ে ছয়জনের সংসার চলত। কিন্তু করোনাকাল শুরুর পর আগের মতো বেচাকেনা নেই। এখন এক-দেড় শ টাকা আয় তাঁর। 

সংসার কীভাবে চলছে, কথা তুলতেই মঞ্জু রানী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘উপায় কী, জীবন তো আর থাইম্মা থাহে না’। মঞ্জু রানীর কথা শুনে পাশে দাঁড়ানো তাঁর স্বামী সঞ্জয় নির্বাক ছিলেন।

মঞ্জু রানীর বাড়ি থেকে পশ্চিম দিকে এগোতে মেঠোপথটা নদে ভেঙে ভেঙে আরও সরু হয়ে গেছে। এই পথ ধরে যেতে দেখা গেল, কাঁথা সেলাই করছেন পলাশী রানী। ৪০ বছর বয়সী এই নারীর ছোট্ট বাড়ির ভূখণ্ডটুকু পাণ্ডব নদ গিলে খাওয়ার অপেক্ষা করছে। পলাশীর স্বামী শ্যামল পাইক হোগলা বুনে আর পলাশী কাঁথা তৈরি করে বিক্রি করেন। দুজনের আয়ে ছয়জনের সংসারটা এত দিন ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনা তাতে বাদ সেধেছে। পাশের সুখী নীলগঞ্জ ও হলতা বাজারে এখন আর তেমন ক্রেতা নেই। তাই হোগলার তেমন চাহিদাও নেই।

পলাশীর সেলাই করা কাঁথার বেশ সুনাম এলাকায়। আগে তিন–চার হাজার টাকা আয় হতো। দুজনের আট–নয় হাজার টাকা আয়ে সংসার ভালোই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন আয় কমে দুই-আড়াই হাজারে ঠেকেছে। ফলে সংসার চলছে অনটনে। 

তবে সরকারের পক্ষ থেকে এসব নিম্নবিত্ত পরিবারকে তিন মাস ধরে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। যদিও সবাই তা পাচ্ছে না। জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে গত ২৭ মে পর্যন্ত বরিশাল জেলা ও নগরে ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৪০০ পরিবারের মধ্যে মানবিক সহায়তা ও ঈদ উপহার হিসেবে ৩ হাজার ৬৪৪ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করেছে জেলা প্রশাসন ও নগর কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিতরণ করেছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকার এবং ২৮ লাখ ৪০ হাজার টাকার শিশুখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।

>আয় কমেছে সব স্তরের মানুষের
নিম্ন আয়ের মানুষের মতো সংকটে গ্রামের বিত্তরাও
করোনাকালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে পথে বসার উপক্রম হয়েছে অনেকের
বরিশালে ১৬৬টি এনজিও রয়েছে। সরকারের নির্দেশে কিস্তি আদায় এত দিন বন্ধ থাকলেও ১ জুন থেকে আবার শুরু হয়েছে

বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরিশাল জেলায় এখন পর্যন্ত মানবিক সহায়তা হিসেবে মোট ৪ হাজার ৫০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা এবং শিশুখাদ্য বাবদ আরও ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি।’

সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মধ্যবিত্ত

খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের মতো সংকটে পড়েছেন গ্রামের বিত্তরাও। তাঁরা না পারেন সাহায্যের জন্য হাত পাততে, আবার না পারেন অভাবের কথা মুখ ফুটে বলতে। ফলে করোনার প্রবল ঢেউয়ে ভেতরে ভেতরে তাঁরা ক্ষতবিক্ষত।

এ রকম কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা বললেন, জীবনধারণের চাহিদা মেটাতে তাঁদের অনেকেরই সঞ্চয়ে-বিনিয়োগে হাত পড়েছে। সামাজিক গতিশীলতা ও উন্নয়নের পরিবর্তে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের পিছিয়ে পড়া নিয়ে এখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০১৫ সালের এক গবেষণা বলছে, ১৯৯১ সালে মধ্যবিত্তের হার ছিল ৯ শতাংশ। ২০১৫ সালে এই হার ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালে মধ্যবিত্তের হার হবে ২৫ শতাংশ এবং ২০৩০ সালে হবে ৩৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী, দৈনিক ২ থেকে ১৩ ডলার খরচ করার সক্ষমতা যাঁরা রাখেন, তাঁদের মধ্যবিত্ত বলা হয়।

 গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরছে না 

বরিশাল-বাকেরগঞ্জ-বরগুনা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশের বাকেরগঞ্জের মহেশপুর একটি প্রসিদ্ধ বাজার। আগে বাজারটি দিন-রাত মানুষের কোলাহলে মুখর থাকত। গত সোমবার সন্ধ্যায় দেখা গেল, বাজারটির সেই চিরচেনা রূপ বদলে গেছে। করোনা যেন গ্রামের অর্থনীতির চাকা আটকে দিয়েছে। বাজারের কয়েকটি চায়ের দোকানে কিছু লোক চা পান করছিলেন। তাঁদের কেউ গালগল্প, কেউ টিভি দেখছিলেন। তবে শারীরিক দূরত্ব কেউ মানছেন না। কারও মুখে মাস্কও ছিল না।

ইসহাক আলী আকন (৫০) এই বাজারের বড় মুদি ব্যবসায়ী। সন্ধ্যার পর তাঁর দোকান ছিল ক্রেতাশূন্য। আগে প্রতিদিন ২০-৩০ হাজার টাকা বিক্রি করতেন, এখন ৮-১০ হাজারে নেমেছে। ঋণের টাকা পরিশোধ, সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে এখন সঞ্চয়ের ওপর হাত বাড়াতে হচ্ছে তাঁকে। বললেন, ‘চালান ভাইঙ্গা এহন সোংসার চালাইতে আছি—এই রহম কয় দিন পারমু কইতে পারি না।’

ইসহাকের কথার সত্যতা পাওয়া গেল বাজারের একটু দূরে আরেক ব্যবসায়ী সুলতান তালুকদারের (৪৫) সঙ্গে কথা বলে। তিনি রড-সিমেন্টের পাশাপাশি মুদি ব্যবসায়ী। আগে প্রতি মাসে যেখানে ৮০০-৯০০ বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হতো, এখন সেখানে ১০০ বস্তাও হয় না। প্রতিদিন যে বেচাবিক্রি হয়, তা দিয়ে সংসার খরচ ওঠে না। এ জন্য তাঁকেও মূলধনে হাত দিতে হয়েছে। সুলতান আক্ষেপ করে বললেন, ‘মোগো বাঁচনের কোনো উপায় দেহি না।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৮ সালে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বিপরীতে আয় বেড়েছে মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার ব্যবধান বেড়েছে গড়ে ৬ শতাংশ। ব্যয় বৃদ্ধির সব সূচকে আগে থেকেই বাড়তি চাপের মধ্যে ছিল মধ্যবিত্ত। এখন করোনাভাইরাসের হানায় এ সংকট আরও তীব্র হবে সন্দেহ নেই। 

 এনজিওর কিস্তি উঠছে না

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বরিশালে ১৬৬টি এনজিও রয়েছে। বেশির ভাগ এনজিও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। করোনা পরিস্থিতির জন্য সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানের কিস্তি আদায় এত দিন আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ থাকলেও ১ জুন থেকে আবার শুরু হয়েছে। এতে ঋণগ্রহীতাদের দুশ্চিন্তা বেড়েছে।

বাকেরগঞ্জের কৃষ্ণকাঠি গ্রামের জাহাঙ্গীর হাওলাদার (৫৫) কিস্তি নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। এই গ্রামের সবচেয়ে বড় ঘেরের মালিক তিনি। বছর পাঁচেক আগে গ্রামের কয়েক ব্যক্তির কাছ থেকে ৭ লাখ টাকায় চার একর জমি দীর্ঘমেয়াদি ইজারা নিয়ে তিনি তিনটি ঘের করেছিলেন। এতে তিনি নিজের সব সঞ্চয় এবং তিনটি এনজিও থেকে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। মাছও বেশ বেড়ে উঠেছিল। কিন্তু করোনার কারণে বাজারে চাহিদা না থাকায় মাছ বিক্রি করতে পারেননি। এ ছাড়া সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্পানে দুটি ঘেরের মাছ ভেসে যায়। এতে পথে বসার উপক্রম হয়েছে জাহাঙ্গীর হাওলাদারের। বললেন, ‘এত অভাবের কথা না পারি কেউরে কইতে, না পারি কেউর ধারে হাত পাততে। সইয়্যা সইয়্যা এহন মরণ ছাড়া কোনো উপায় দেহি না।’

বেসরকারি ঋণদান সংস্থা আশার বরিশাল জেলায় সদস্যসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। তারা ঋণের কিস্তি আদায় মে মাস পর্যন্ত বন্ধ রেখেছিল। ১ জুন থেকে পুনরায় চালু করেছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বিপর্যস্ত হওয়ায় অনেকেই ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারছেন না। আশার জেলা ব্যবস্থাপক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কাউকে কিস্তির জন্য জোর করছি না। তবে ঋণ আদায়ের হার খুব কম। মানুষের আয় নেই। সংসার চলছে টানাটানিতে।’

জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, কর্মসংস্থানের অভাবে বরিশালের মানুষের আর্থিক অবস্থা করোনার কারণে অনেক খারাপ। তার ওপর নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ জেলায় বেশি। এই অবস্থায় এনজিওর কিস্তি নেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা উচিত।

হাটের দিন হলেও বাজারে ক্রেতা কম। বিক্রেতা তাই অলস সময় কাটাচ্ছেন। মঙ্গলবার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামুদ্দি ইউনিয়নের হলতা বাজারে।  ছবি: প্রথম আলো
হাটের দিন হলেও বাজারে ক্রেতা কম। বিক্রেতা তাই অলস সময় কাটাচ্ছেন। মঙ্গলবার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামুদ্দি ইউনিয়নের হলতা বাজারে। ছবি: প্রথম আলো

মানুষের আয় কমছে

করোনায় মানুষের আয় কমে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে ব্র্যাক, ডেটা সেন্স ও উন্নয়ন সমন্বয়ের যৌথ সমীক্ষায়। ১ জুন প্রকাশিত ওই সমীক্ষায় বলা হয়, করোনা ছড়িয়ে পড়ার কারণে দেশের প্রায় ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষ অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রায় ৭৪ শতাংশ পরিবারের উপার্জন কমে গেছে। দেশে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র (দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯ ডলার)। তাদের মধ্যে নতুন করে চরম দরিদ্র হয়ে পড়া পরিবারগুলোও রয়েছে।

সমীক্ষায় বলা হয়, কোভিড-১৯–এর কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বহুবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেসব পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তার মধ্যে ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য চাকরি হারিয়েছেন।

গত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে গড় পারিবারিক উপার্জন প্রায় ৭৪ শতাংশ কমে গেছে। দিনমজুরসহ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ব্যাহত

করোনা পরিস্থিতির কারণে বরিশালের প্রত্যন্ত এলাকার পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তৃণমূলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে আগের মতো পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যাপারে এখন আর দম্পতিরা আসেন না। অস্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি (ইনজেকশন), স্থায়ী বন্ধ্যাত্বকরণ (লাইগেশন) পদ্ধতি গ্রহণের হারও কমছে। 

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে দেশে সক্ষম দম্পতি প্রায় ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এখন এ সংখ্যা ৬৩ দশমিক ১ শতাংশ। আর বরিশালে এ হার ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশ।

বাকেরগঞ্জের চরাদী ইউনিয়নের গোপালপুর এলাকার এক দম্পতি কয়েক বছর ধরে অস্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছিলেন। কিন্তু করোনা দুর্যোগের কারণে গত এপ্রিলের পর সেই পদ্ধতি আর গ্রহণ করতে পারেননি। করোনা সংক্রমণ এড়াতে তিনি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছেন না। কিন্তু অস্থায়ী পদ্ধতি হিসেবে কনডম ও বড়ি গ্রামে সহজলভ্য নয়। বাজার দূরে হওয়ায় সেটা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য।

মাঠপর্যায়ের সেবা গ্রহণকারী ও সেবাদানকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দম্পতিদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বড়ি, ইনজেকশন ও কনডম। বিশেষ করে বড়ি ও কনডম সম্পর্কে দেশে কমবেশি সব নারী–পুরুষের কিছুটা হলেও ধারণা আছে। ফলে এসব পদ্ধতি গ্রহণের হার বেশি।

চরাদী ইউনিয়নের গোপালপুর, বলইকাঠি, হলতা, সন্তোষদি ও সাগরদি—এই পাঁচটি গ্রাম নিয়ে গঠিত কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের দায়িত্বে আছেন হেলথ প্রোভাইডার ফারজানা আক্তার। তিনি বললেন, আগে যেখানে প্রতি মাসে ৮০-৯০ দম্পতি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি নিতে ক্লিনিকে আসত, এখন ৩০-৪০–এ নেমে এসেছে। দিন দিন এই সংখ্যা কমছে।

এই গ্রামগুলোতে মাঠপর্যায়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কনডম, বড়ি ও সেবা দেন পরিবারকল্যাণ সহকারী রিনা বেগম। তিনি বললেন, ‘করোনাকালে বিরূপ পরিস্থিতি কিছুটা তো আছেই। তবে সেটা আমাদের কাজে তেমন প্রভাব ফেলছে না। কেউ ফোন করে কনডম, বড়ি চাইলে আমরা পৌঁছে দিই।’

জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ বলছে, বরিশাল জেলায় সক্ষম দম্পতির সংখ্যা ৪ লাখ ২৪ হাজার ২৯০।

 কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা স্থবির

শুধু পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম নয়, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাকেরগঞ্জ উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টিতে ১০০ মাধ্যমিক স্কুল-মাদ্রাসায় কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতার কাজ করে আন্তর্জাতিক শিশু সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সেইন্ট বাংলাদেশ। 

প্রকল্পের আওতায় ১০০ বিদ্যালয়ে কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং কমিউনিটি পর্যায়ে ৭২টি দলে প্রতি মাসে একটি সভার আয়োজন এবং উপজেলার প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে কিশোরী কর্নার চালু করে সেখানে আসা কিশোরীদের কাউন্সেলিং, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী প্রদানের কার্যক্রম চলে। কিন্তু করোনার কারণে তিন মাস ধরে এ কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে।

কাঁথা বুনে আগে আয় হতো ভালোই। এখন তা কমে গেছে অনেকখানি। সোমবার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণকাঠি গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
কাঁথা বুনে আগে আয় হতো ভালোই। এখন তা কমে গেছে অনেকখানি। সোমবার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণকাঠি গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

গর্ভবতী ও প্রসবোত্তর সেবাও স্থবির

করোনাকালে জীবন-জীবিকার মতো গর্ভবতী ও প্রসবোত্তর সেবা গ্রহণের হারও কমে গেছে এই অঞ্চলে। বাকেরগঞ্জের চরাদী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ প্রোভাইডার ফারজানা আক্তার বলছিলেন, গর্ভবতী ও প্রসবোত্তর সেবা গ্রহণকারীদের সংখ্যা এখন ক্রমেই কমছে। ফেব্রুয়ারিতে তাঁদের যেখানে প্রতি মাসে ৩০-৩৫ জন গর্ভবতী সেবা নিতেন, সেখানে মে মাসে তা কমে ২০ জনে এসেছে।

বরিশাল জেলায় গেল ফেব্রুয়ারিতে গর্ভবতীসেবা গ্রহণ করেছেন ৩ হাজার ২৪১ জন। সেখানে মে মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩২৬ জনে। আর ফেব্রুয়ারিতে প্রসবোত্তর সেবা নিয়েছিলেন ১ হাজার ৪৯১ জন। মে মাসে তা নিয়েছেন ৮৯২ জন নারী।

জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক মু. জসিম উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে তৃণমূলের স্থায়ী, স্বল্প স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ও গর্ভবতী, প্রসবোত্তর সেবা গ্রহণকারীদের সংখ্যা অনেক কমেছে। মাঠপর্যায়ে স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের বিষয়ে যেসব মাসিক সভা হতো, সেগুলোও তিন মাস ধরে বন্ধ আছে।