করোনার আগের ঈদের কথা মনে পড়ে?

করোনাভাইরাসের মহামারি চলছে এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেল। এর মধ্যেও কেটে গেল তিন ঈদ, এবার চতুর্থটির পালা। সময়টা দীর্ঘ। সেই সঙ্গে যখন রোগে–অসুখে ভোগার তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং অদূর ভবিষ্যতের বিষয়ে অনিশ্চয়তা যোগ হয়, তখন মুহূর্তগুলো আরও দীর্ঘ হয়ে ওঠে। এমন অবস্থাতেই আনমনে প্রশ্ন জাগে, করোনার আগের ঈদ কেমন ছিল?

করোনার আগের ঈদের কথা বলতে গেলে ফিরে তাকাতে হবে ২০১৯ সালে। ওই বছরটাতেই আমরা সর্বশেষ মুক্ত মুখে ঈদ করেছিলাম। কোনো সামাজিক দূরত্বের বালাই ছিল না তখন। কারও মুখে মাস্ক না দেখলে অস্বস্তিও হতো না; বরং কোরবানির পশু কেনা এবং তা বাড়িতে নিয়ে আসায় উৎসাহ–উত্তেজনা ছিল প্রবল। ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার অজানা ভয় তখন আমাদের সংকুচিত করত না। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হলেই হতো কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়। চলত আড্ডা। আর পরিচিতজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া তো ছিলই।

নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছেন? স্মৃতিরা কি মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে আন্দোলিত করছে প্রবলভাবে? মনে কি হচ্ছে—আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম?
এভাবে স্মৃতিতে আহত হওয়ার পর হৃদয় কিছুটা ভারাক্রান্ত হতেই পারে। তবে শুধু সুখটুকু ধরে রেখে সামনের দিকেও তো তাকানো যায়। হ্যাঁ, এখন উৎসবের মাঝেও দুশ্চিন্তা। ভয় হয়, কখন করোনাহত হতে হয়! তবে তারপরও আনন্দে উদ্বেল হওয়া দোষের নয়। আনন্দ–বেদনার মিশেলই তো জীবন।

সুখস্মৃতি স্মরণ করার বিষয়টি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, সব ধরনের মানসিক চাপ সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে সুখস্মৃতি খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। দুঃখবোধ, একাকিত্ব ও অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় অতীতের এই সুখস্মৃতি খুবই কাজে দেয়। এতে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ করার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া যায়। বিজ্ঞানের ভাষায়, মানুষ এমন এক প্রাণী প্রজাতি, যারা অস্তিত্বের সংকটে বিপন্ন বোধ করে। এগিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষের এমন সামাজিক যোগাযোগ ধরে রাখতে হয়, যার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে কিছু অবদান রাখা যায়। এই অস্তিত্ব ধরে রাখার বিষয়টিতেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে নস্টালজিয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, নস্টালজিয়া জীবনের লক্ষ্য অর্জনে উৎসাহ জোগায়।

করোনা একদিন চলে যাবে নিশ্চয়ই। এই পৃথিবীতে মহামারি এই প্রথমবার আসেনি। আগের মহামারিগুলোর ইতিহাস পড়লে জানা যাবে, ওই সময়ও মনে হয়েছিল, এ নিদারুণ কাল বুঝি শেষ হওয়ার নয়! তবে সেটিও একসময় চলে গেছে। মানুষ ও প্রকৃতি আবার হেসেছে স্বাভাবিকের মতো। তো করোনা মহামারি যেদিন চলে যাবে, সেদিন এ সময়ের দুঃসহ স্মৃতিও সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। কারণ, মনোবিদদের কথায়, মানুষ দুঃখের স্মৃতি ভুলে যায় তাড়াতাড়ি। জ্বলজ্বল করে অতীতের সুখী মুহূর্তগুলো।

গবেষকদের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বেদনার স্মৃতি ভুলে আনন্দদায়ক স্মৃতি বেশি মনে রাখে মানুষ। এতে একজন ব্যক্তি সুখী ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারে। এতে করে জীবনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সহজ হয় এবং বহতা নদীর মতো জীবনে ইতিবাচক থাকা যায়। ১৯৩০–এর দশকে করা এমনই এক গবেষণায় দেখা গেছে, অপ্রীতিকর ঘটনার স্মৃতির ৬০ শতাংশই মানুষ ভুলে যায়। আর আনন্দের স্মৃতির ক্ষেত্রে ভুলে যাওয়ার হার ৪২ শতাংশ।

সুতরাং, জীবনে চলার পথে ভবিষ্যতের জ্বালানি জোগাতে করোনার আগের ঈদের ‘মুক্ত’ সময়ের স্মৃতি মনে করা যেতেই পারে। তবে তার ফাঁকে ফাঁকে চারপাশের মানুষেরও একটু খবর রাখবেন, প্লিজ! এখনো ঘরের বাইরে পা বাড়ালে শুনতে হয় সাহায্য চেয়ে নানা কিসিমের মানুষের কাতর অনুরোধ। সেই অনুরোধে কেউ পাশ না কাটিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে, তাই হয়তো হয়ে দাঁড়ায় কারও বেঁচে থাকার অবলম্বন। তাতেই কারও মুখে ফোটে একচিলতে হাসি।

সহায়তা চাওয়া কাতর হাতের সামনে বারবার দাঁড়ানোর সময়টায় সবকিছুই কেমন জানি অবাস্তব বোধ হতে থাকে। মনে হতে থাকে, এসব কিছুই সত্যি নয়। দুঃস্বপ্ন ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মহামারির শুরু থেকে অনেকেরই এমন বোধ হচ্ছে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়্যারড-এর এক নিবন্ধে লেখা হয়েছে, প্যানডেমিকের কালে পশ্চিমা দুনিয়াতেও এমনটা দেখা যাচ্ছে। ঘরবন্দী জীবন কাটাতে কাটাতে অনেকেরই নাকি বর্তমান বাস্তবতাকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন প্রবণতা অস্বাভাবিক নয়। মানুষ যখন দীর্ঘদিনের রুটিন ভেঙে ফেলে ঘর ও নিয়মবন্দী অনিশ্চিত এবং আগে কখনো কল্পনাও করেনি এমন অভাবিত জীবন কাটাচ্ছে, তখন এমন প্রবণতা দেখা দিতে পারে। কারণ, যখন মানুষ হাজার চেষ্টা করেও একটি ধাঁধার সঠিক ও নিশ্চিত উত্তর খুঁজে পায় না, তখন সে কিছুটা বিশৃঙ্খল হয়ে যায়।

এ থেকে বাঁচার উপায়ও বিশেষজ্ঞরা বাতলে দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, আমাদের সহানুভূতিশীল হতে হবে, সহমর্মী হতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনেই মানুষে মানুষে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে হবে, প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সবার এক হয়ে থাকার বিকল্প নেই। কাউকে একা হয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।

আর এই সর্বজনীন উৎসবের দিনটায় আসলে একা হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টাই অনর্থক। উৎসবের আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াটাই প্রচলিত। এই করোনার কালে তাতে একটু বাড়তি প্রচেষ্টা যোগ করা যেতেই পারে। অন্যান্য দিনের মতো ঈদের দিনে একে-অপরের পাশে দাঁড়ানোটা যে আরও বেশি দরকার, শ্রেণি-বিত্তনির্বিশেষে। একজনের খুশিকে ছড়িয়ে দিতে হবে আশপাশের মানুষের মাঝে। তবেই তিতকুটে করোনার ফাঁক গলে ঈদের সকালে নাকে আসবে গন্ধরাজের সুবাস।