করোনায় চট্টগ্রামে দিনে ১৮টি বিবাহবিচ্ছেদ

পারিবারিকভাবে ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে হয় জান্নাতুল ফেরদৌসের (ছদ্মনাম)। নতুন সংসার নিয়ে বুনতে থাকেন স্বপ্নের জাল। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই পাল্টে যায় সব। ঠুনকো কারণে শুরু হয় স্বামীর নির্যাতন। এর মধ্যে আসে করোনা মহামারি। আশায় ছিলেন, এমন পরিস্থিতিতে স্বামীর বোধোদয় হবে। কিন্তু কিসের কী? উল্টো বাড়তে থাকে মারধর ও হুমকি-ধমকি। অতিষ্ঠ হয়ে বিয়ের ছয় মাসের মাথায় গত ৪ জুন স্বামীকে তালাকের নোটিশ দেন এই গৃহিণী।

করোনার আতঙ্কে মানুষ যখন ঘরবন্দী সময় পার করছেন, তখন জান্নাতুলের মতো অনেকেই পারিবারিক জটিলতায় বিবাহবিচ্ছেদের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার সংক্রমণের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এই বিচ্ছেদের নোটিশ তৈরি ও জমা দিতে ছুটতে হচ্ছে আইনজীবীদের দুয়ারে।

কয়েক বছর ধরে এমনিতেই চট্টগ্রাম নগরে সংসার ভাঙার হার বাড়ছিল। এখন করোনা এতে নতুন মাত্রা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এ বছর সেখানে (২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৪ হাজার ৭৭৩টি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। দিনে ১৮টি।

করোনাকালে সিটি করপোরেশনের সালিসি আদালতে জমা পড়া আবেদনের মধ্যে প্রায় ৩০টি পর্যালোচনা করে দেখেন এই প্রতিবেদক।

বিবাহবিচ্ছেদের জন্য নারীদের উল্লেখ করা প্রধান কারণগুলো হচ্ছে, শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য চাপ, স্বামীর মাদকাসক্তি ও উগ্র মেজাজ, গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে বা পরকীয়া ইত্যাদি। আর পুরুষদের দাবি করা অভিযোগগুলো হচ্ছে পরকীয়া, ধর্মীয় রীতি-নীতি না মানা, বেপরোয়া আচরণ, অবাধ্য হওয়া এবং সংসারের কাজকর্মে মনোযোগ না দেওয়া।

অনেক সময় তুচ্ছ কারণেও সংসার ভেঙে যাচ্ছে বলে জানান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌস। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ আবেদনকারী নোটিশ প্রত্যাহার করে পুনরায় সংসারে ফিরে যান।

২০১৪ সালে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন ৩ হাজার ২৬৮ জন। ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৪৮৬টি, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৯৬১টি, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৯২৮টি ও ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৩৩১টি আবেদন জমা পড়ে। আর সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৫৫০ জন আবেদন করেছিলেন গত বছর।

চট্টগ্রামে পুরুষদের তুলনায় নারীরাই বেশি বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছেন। কোন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বেশি বিচ্ছেদ হচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে নিম্ন ও উচ্চবিত্ত পরিবারে তালাকের সংখ্যা বেশি বলে জানিয়েছেন সালিসি আদালতের বিচারক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে সন্তানেরা।

সংসার ভাঙার পেছনে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাব বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী-স্ত্রী পেশাগত কারণে ব্যস্ত সময় পার করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবেও পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হয়। এসব কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে।

করোনায় বেড়েছে আবেদন

সম্প্রতি তালাকের নোটিশ জমা দিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে এসেছিলেন কলেজছাত্রী ফারহানা আক্তার (ছদ্মনাম)। ‘চাকরিজীবী’ ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন এক বছর আগে। কিন্তু করোনার সময় জানতে পারেন, ওই ছেলে কোনো চাকরি করে না। আর যৌতুকের জন্য এ সময় শারীরিকভাবেও হেনস্তা করতে থাকেন। প্রতারণার বিষয় জেনে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছেন বলে জানান তিনি।

লকডাউন শুরুর আগের তিন মাসে সিটি করপোরেশনের সালিসি আদালতে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) তালাকের জন্য আবেদন করেছিলেন ১ হাজার ২৪৫ জন। করোনার কারণে অফিস বন্ধ থাকায় এপ্রিল ও মে মাসে বিচ্ছেদের নোটিশ নেওয়া হয়নি।

সীমিত আকারে অফিস চালুর পর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসে আবেদন করেন ১ হাজার ৫০৭ জন। আর ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বছরে মোট নোটিশ জমা পড়েছে ৪ হাজার ৭৭৩টি। বছর শেষে এই সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম আবেদন জমা পড়েছিল ২০১৪ সালে। ওই বছর বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন ৩ হাজার ২৬৮ জন। ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৪৮৬টি, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৯৬১টি, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৯২৮টি ও ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৩৩১টি আবেদন জমা পড়ে। আর সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৫৫০ জন আবেদন করেছিলেন গত বছর।

নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে সংসার অক্ষুণ্ন রাখার তাগিদ কম। বিশেষ করে নারী পোশাকশ্রমিকদের বেতনের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন স্বামীরা। তা মানতে পারেন না বলে অনেক নারী তালাক দেন।
জাহানারা ফেরদৌস, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট

সিটি করপোরেশনের সালিসি আদালতে ৫০০–এর বেশি আবেদন পড়েছে, এ রকম মাসের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু লকডাউনের পর এখন প্রতি মাসেই ৫০০–এর বেশি তালাকের আবেদন জমা পড়ছে।

গত বছরের জুনে যেখানে মাত্র ১৭৪টি নোটিশ জমা পড়েছিল, এবার সেখানে জমা হয় ৪১২টি। এরপর জুলাই মাসে ৫০৩, আগস্টে ৫৯২, সেপ্টেম্বরে ৫৮০, অক্টোবরে ৬১৯, নভেম্বরে ৫৭৫টি আবেদন জমা পড়েছে। অথচ গত বছরে আগস্টে ৩০২টি, সেপ্টেম্বরে ৪৩৩টি, অক্টোবরে ৪৯০টি নোটিশ জমা হয়েছিল।

ঘরে মেডিকেলপড়ুয়া মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে আছে এক ব্যাংক কর্মকর্তার। সংসারের বয়স ৩০ পার হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থায় গৃহিণী স্ত্রীকে তালাক দিতে নোটিশ দিয়েছেন স্বামী। দিশেহারা ওই নারী সংসার কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, তার পথ খুঁজতে এসেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। ম্যাজিস্ট্রেটও চেষ্টা করছিলেন যেন এই সংসার টিকে থাকে। কিন্তু বিচ্ছেদের জন্য অনড় রয়েছেন স্বামী। চোখের পানি মুছতে মুছতে সম্প্রতি সিটি করপোরেশন থেকে বের হচ্ছিলেন এই নারী। কান্নার কারণে কিছুই বলতে পারলেন না।

করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ আলা উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে একসঙ্গে দীর্ঘ সময় থাকার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। এভাবে থাকার কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধনে ইতিবাচক প্রভাব রাখলেও অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীরা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন। এতে নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া করোনার কারণে আর্থিক সংকট, চাকরি হারানোসহ নানা কারণে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব চাপ ও দুশ্চিন্তার কারণে অনেকেই বেছে নিয়েছেন বিচ্ছেদের পথ।

ভাঙনের যত কারণ

করোনাকালে সিটি করপোরেশনের সালিসি আদালতে জমা পড়া অন্তত ৩০টি আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব আবেদনের ভাষায় তেমন পার্থক্য নেই। অনেক সময় তুচ্ছ কারণেও সংসার ভেঙে যাচ্ছে বলে জানান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌস। তিনি বলেন, নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে সংসার অক্ষুণ্ন রাখার তাগিদ কম। বিশেষ করে নারী পোশাকশ্রমিকদের বেতনের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন স্বামীরা। তা মানতে পারেন না বলে অনেক নারী তালাক দেন।

বিবাহবিচ্ছেদে ইচ্ছুক স্বামী বা স্ত্রীকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা লিখিতভাবে (তালাক নোটিশ) প্রথমে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে জানাতে হয়। যাঁকে তালাক দিতে ইচ্ছুক, তাঁকেও সেই নোটিশ পাঠাতে হয়। কারও কাছ থেকে আবেদন পাওয়ার পর মেয়র নোটিশটি সালিসি আদালতে পাঠিয়ে দেন। এই আদালতে মেয়রের পক্ষে নিযুক্ত থাকেন স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ)। আদালত বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর করার আগে স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষকে তিন মাসে তিনবার নোটিশ দেন। দুই পক্ষের কোনো পক্ষ বা দুই পক্ষই হাজির হলে সমঝোতার চেষ্টা চালান আদালত। কিন্তু সমঝোতা না হলে আইন অনুযায়ী ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

করোনার কারণে আর্থিক সংকট, চাকরি হারানোসহ নানা কারণে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব চাপ ও দুশ্চিন্তার কারণে অনেকেই বেছে নিয়েছেন বিচ্ছেদের পথ।
মুহাম্মদ আলা উদ্দিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছিলেন রংপুরের বাসিন্দা আকতার হোসেন (ছদ্মনাম)। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসেন তিনি। কিন্তু কয়েক দিন পর সংসার করবেন না জানিয়ে স্ত্রী বাবার বাড়ি চলে যান বলে জানান তিনি। এই অবস্থায় তালাক দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে দাবি করেন আকতার।

বিবাহবিচ্ছেদ প্রতিরোধে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ দূর করতে কাউন্সেলিং, তালাকের পর সন্তানদের ভবিষ্যৎ তুলে ধরা এবং স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে পরিবারের গুরুত্ব উপস্থাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।