করোনায় বিপর্যস্ত পরিবহন খাত দাঁড়াতে পারেনি

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে যাত্রীবাহী যানবাহন টানা ৬৭ দিন বন্ধ ছিল
ফাইল ছবি

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে পরিবহন খাত। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে যাত্রীবাহী যানবাহন টানা ৬৭ দিন বন্ধ ছিল। এরপর আরও তিন মাস চলেছে নানা বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে। এখন বিধিনিষেধ উঠে গেলেও যাত্রী আগের অবস্থানে যায়নি। আয় কমার কারণে ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন পরিবহনমালিকেরা। পরিবহনশ্রমিকদের চাকরির ধরনটা এমন যে কাজ থাকলে আয় আছে, না থাকলে নেই। ফলে শ্রমিকেরাও দুরবস্থার মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন।

দুর্দিন চলছে রেল ও আকাশপথে যোগাযোগেও। রেল যোগাযোগে এখন তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে যাত্রীর পরিমাণ ও আয় আগের অবস্থানে যায়নি। রেলের কর্মকর্তারা মনে করছেন, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির ধাক্কায় ২০২০ সালে রেলের আয় ও যাত্রী পরিবহন দুটোই ৪০ শতাংশ কম হবে। জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের রুট কখনো বন্ধ আবার কখনো চালু—এই ধারায় চলছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে প্রায় ৪৫ লাখ। পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যানবাহন চালনার সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক। করোনা সবাইকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

করোনা সংক্রমণের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে যাত্রীবাহী পরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পণ্যবাহী পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকার কারণে সে সময় ২-৩ শতাংশের মতো পণ্যবাহী যান চলাচল করে।

পরিবহনমালিক সমিতিগুলো বলছে, নজিরবিহীন পরিবহন-সংকটে ওই সময়টায় দৈনিক গড়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ১ জুন থেকে যাত্রীবাহী পরিবহন চালু হয়। পুরোপুরি বিধিনিষেধ উঠে যায় ৩১ আগস্ট।

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পরিবহন খাতে এমন অচলাবস্থার কথা মনে করতে পারছেন না পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে দেশে হরতাল-অবরোধে ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও পরিবহনমালিকেদের করা তখনকার এক সমীক্ষায় দেখা যায়, সেই কঠিন পরিস্থিতিতেও দেশের ৬০ শতাংশ গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যান চালু ছিল। বিশেষ করে সরকার ও সরকার সমর্থক পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারায় যান চালু রেখেছিলেন।

পণ্যবাহী প্রায় সব যানবাহন এবং কোম্পানিভিত্তিক পরিচালিত যাত্রীবাহী যানের ৮০ শতাংশের বেশি কেনা হয়েছে ব্যাংকঋণে। অনেকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান থেকে চড়া সুদে কিস্তিতে যানবাহন কিনেছেন। করোনার কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে খেলাপি হবে না বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে। তবে কিস্তি পরিশোধ বন্ধ থাকলেও ঋণ তো রয়েই যাচ্ছে, সুদ বহাল আছে। সব মিলিয়ে পরিবহনমালিকদের কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ দাবি করেছেন, এখনো ঢাকা এবং দূরপাল্লার পথে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পরিবহন চালু হয়নি। এ অবস্থায় ঋণের সুদ মওকুফ না করলে পরিবহনমালিকেরা দেউলে হয়ে যাবেন।

করোনা পরিবহন খাত যেভাবে ভোগাচ্ছে

বন্ধের সময় বিভিন্ন বাস টার্মিনাল, রাস্তার পাশে, খোলা মাঠে যাত্রীবাহী পরিবহন রেখে দিতে হয়েছে। দীর্ঘদিন চলাচল না করলে এমনিতেই যানবাহনের ব্যাটারি অচল হয়ে যায়। জং ধরে যন্ত্রপাতিতে। টায়ার ও ব্রেক ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। করোনাকালে এর পেছনেও পরিবহনমালিকদের বাড়তি ব্যয় করতে হয়েছে। এ ছাড়া খোলা জায়গায় কিংবা রাস্তার পাশে বাস রাখার কারণে রাতে পাহারাদারও নিয়োগ করতে হয়েছে পরিবহনমালিকদের।

যাত্রী পরিবহনে যুক্ত একাধিক সূত্র বলছে, যাত্রী পরিবহন এখনো স্বাভাবিক না হওয়ার কয়েকটি কারণ আছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, ভারতের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ কমে যাওয়া, গ্রামমুখী ও পর্যটনকেন্দ্র ধরে পারিবারিক যাতায়াত কমে যাওয়া উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বাংলাদেশে সারা বছরই কোনো না কোনো উৎসব, উপলক্ষ থাকে, যে সময় মানুষ বেড়াতে যায়। করোনার কারণে সেটাও এখন আর হয়ে উঠছে না। বাস্তবতা হচ্ছে, এখনো স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ যাত্রী ও মালামাল পরিবহন কম হচ্ছে।

পণ্য পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত সূত্র বলছে, পণ্যবাহী যানবাহনে নির্মাণসামগ্রী, পোশাক কারখানার মালামাল, কৃষি ও খাদ্যপণ্য সবচেয়ে বেশি পরিবহন হয়। কিন্তু করোনার কারণে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে জুন পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য কোনো পণ্য পরিবহন হয়নি। বিশেষ করে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় এবং পোশাক কারখানার কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ার কারণে বেশির ভাগ পণ্যবাহী যানই বসে থাকে। বর্তমানে পণ্য পরিবহন বেড়েছে। তবে এখনো আগের অবস্থানে যায়নি।

করোনাকালে ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করেছেন যাত্রীরা
ফাইল ছবি

নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত দাবি করে ব্যাংকঋণের সুদ মওকুফের দাবি জানিয়ে ১৭ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। চিঠিতে তারা বলেছে, ৬৭ দিন বাস-মিনিবাস চলাচল বন্ধ থাকার কারণে পরিবহন খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যানবাহন চালু হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত আশানুরূপ যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার করোনার কারণে অন্যান্য খাতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করলেও পরিবহন খাত কিছু পায়নি। এ অবস্থায় ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকঋণের সুদ মওকুফ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে মালিক সমিতি।

বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে পণ্য পরিবহনে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরি আছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। চাহিদার তুলনায় তা তিন গুণ বেশি। ফলে স্বাভাবিক সময়েই পণ্যের চালান পেতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়। করোনাকালে প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ৯০ শতাংশ পণ্যবাহী পরিবহনই ব্যাংকঋণে কেনা। এখন ঋণের কিস্তিই পরিশোধ করা যাচ্ছে না।

শ্রমিকেরাও দুর্ভোগে

দেশের বাণিজ্যিক প্রতিটি যানবাহন থেকে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে ঘোষণা দিয়ে দিনে ৭০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। দেশে সব মিলিয়ে বাণিজ্যিক যানবাহন আছে ৮ লাখের বেশি। সে হিসাবে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। এর বাইরে অঘোষিত চাঁদার তো কোনো হিসাবই নেই। মালিক-শ্রমিকদের কল্যাণের কথা বলে এসব চাঁদা আদায় হলেও এখন করোনাভাইরাসের দুর্দিনে তাঁদের পাশে ছিল না কেউ। এ সময় শ্রমিকেরা সরকারি ও ব্যক্তিগত ত্রাণের ওপর নির্ভর করে চলেছেন।

ঢাকা-পঞ্চগড় পথে একটি বড় পরিবহন কোম্পানির বাস চালান আবুল বাশার। তিনি বলেন, এখনো পরিবহন কোম্পানিগুলো পুরোদমে বাস চালু করেনি। ফলে অনেক শ্রমিক বেকার। চালক-শ্রমিক বেশি হওয়ার কারণে পর্যায়ক্রমে একেকজন কাজ পান। কেউ কেউ পেশা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন।

সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, সব শ্রমিককে নিয়োগপত্র দেওয়া এবং মাসিক বেতনের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার কথা। কিন্তু দেশের সড়ক খাতে সঠিক বেতনকাঠামো কার্যকর না থাকায় প্রায় ৯৮ শতাংশ পরিবহনশ্রমিক দৈনিক মজুরি বা ট্রিপভিত্তিক চাকরি করে থাকেন। অর্থাৎ দিনে আনে দিনে খায় অবস্থা। এখন তাঁরা পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে তাঁরা ৪২ লাখ শ্রমিকের তালিকা সরকারকে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৬০ শতাংশের মতো শ্রমিক কিছু সময় সরকারি ত্রাণ পেয়েছেন। এখনো শ্রমিকেরা কাজ পাচ্ছেন না। তবে কেউ আর ত্রাণ দিচ্ছে না।

বড় ক্ষতির মুখে রেল ও বিমান

যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় ২৪ মার্চ থেকে। ৩১ মে থেকে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে অল্প কিছু আন্তনগর ট্রেন চালু হয়। তবে কাউন্টারে টিকিট বিক্রি বন্ধ থাকে। পুরোদমে ট্রেন চলাচল শুরু হয় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। তবে রেলওয়ে সূত্র জানায়, এখনো ৯২টি মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চালু হয়নি।

রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ট্রেনে স্বাভাবিক সময়ে গাদাগাদি করে যাত্রী ভ্রমণ করেন। খানিক পরপরই ট্রেন থামে। ফলে যাত্রী ওঠানামাও বেশি। এই ট্রেনগুলোতে সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো উপায় নেই। এ জন্যই লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনের বড় অংশই চালু করা হয়নি।

তবে রেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বন্ধের সময় কিছু কিছু ট্রেনের ইঞ্জিন ও কোচ মেরামত কারখানায় পাঠানো হয়েছে। এ জন্য ইঞ্জিন-কোচের কিছু সংকটও আছে। এ জন্যই সব ট্রেন চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে আন্তনগর ট্রেনের সবই চালু হয়েছে। ওই কর্মকর্তা জানান, করোনার কারণে চলতি বছর যাত্রী চলাচল ও রেলের আয় ৪০ শতাংশ কম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে সারা বিশ্বেই উড়োজাহাজে যাত্রী পরিবহনে ধস নেমেছে। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দশাও একই। আজ এক দেশ বন্ধ তো পরশু আরেক দেশের সরকারের নিষেধাজ্ঞা। বারবার চালু ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই কোনো রকমে চলছে বিমান।