করোনায় বেতন–ভাতা কমেছে পাইলটদের

করোনাকালে বিমানের পাইলটদের বেতন কমেছে ২৫–৫০ শতাংশ। অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কমেছে ১০–২৫ শতাংশ।

  • গত বছরের ৫ মে এক প্রশাসনিক আদেশে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পাইলটদের বেতন কমানো হয়।

  • সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা না কমলেও বিমানে বেতন কর্তনে কর্মীরা ক্ষুব্ধ।

বিমান
প্রতীকী ছবি

করোনাকালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পাইলটসহ কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা কমেছে। এর মধ্যে পাইলটদের বেতন কমেছে সবচেয়ে বেশি, ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। বন্ধ হয়েছে বিভিন্ন ভাতাও। অন্যদিকে বেড়েছে কর্মঘণ্টা।

সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা না কমলেও শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন কর্তন ও ভাতা বন্ধে পাইলটদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।

বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনা মহামারির কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশ বিমানও এ সময় সংকটে পড়েছে। ফলে পরিচালনা পর্ষদ পাইলটসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কমিয়েছে।

পাইলটদের বেতন কম নয়। চাকরিতে নতুন যোগ দেওয়া একজন পাইলটের বেতন ৫০ শতাংশ কাটার পরও যদি ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা বেতন পান, এটা কি কম?
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মোকাব্বির খান

বিমান সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ৫ মে এক প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পাইলটদের বেতন কমানো হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১০ থেকে ২৫ শতাংশ বেতন কমানো হয়। আর পাইলটদের ক্ষেত্রে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেতন কর্তন, স্থায়ী প্রকৃতির ভাতা-ফুড সাবসিডি, মিল ও মিল্ক অ্যালাউন্স না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া পাইলটদের ওভারটাইম, প্রোডাক্টিভিটি অ্যালাউন্স, ফ্লাইং অ্যালাউন্স না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে হতাশ হন বিমানের পাইলটদের সংগঠন বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, বিমান কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে করা কাজের চুক্তি ভঙ্গ করেছে। করোনাকালে বেতন কমানো, ভাতা বন্ধের আগে বিমান কর্তৃপক্ষ পাইলটদের মতামতগুলো গ্রাহ্য করেনি। অথচ এই সময়ে কমসংখ্যক পাইলট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। পাইলটরা বিরতিহীনভাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেও অতিরিক্ত কাজের (ওভারটাইম) ভাতা পাননি। অনেক পাইলট সপরিবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কোনো চিকিৎসা ভাতা পাননি।

পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় স্বার্থ ও প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক প্রয়োজনে পাইলটরা করোনা পরিস্থিতিতেও ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন। করোনার শুরুর দিকে প্রচণ্ড ভয় ও উদ্বেগ নিয়ে লন্ডন বা চীনের উহানে ফ্লাইট নিয়ে গেছেন। তবে বিমান কখনোই পাইলটদের সম্মুখসারীর যোদ্ধা মনে করেনি।

করোনার সময়ে পাইলটরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁদের প্রতি আমরা অনেক কৃতজ্ঞ। ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা কাজ করেছেন। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বিমান খুব বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে না গেলেও সময়টা বেশ খারাপ গিয়েছে।
বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী

করোনার সময়ে কখনো কখনো ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন, এমন একজন পাইলট নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাকালে আমরা অনেক মানসিক চাপ ও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি। নিজে করোনায় আক্রান্ত হয়েছি। চিকিৎসার খরচ তো দূরের কথা, উল্টো বেতন কমানো হয়েছে। এর চেয়ে হতাশার আর কী হতে পারে।’

বেতন কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মোকাব্বির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাইলটদের বেতন কম নয়। চাকরিতে নতুন যোগ দেওয়া একজন পাইলটের বেতন ৫০ শতাংশ কাটার পরও যদি ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা বেতন পান, এটা কি কম?’

এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন পাইলট অ্যাসোসিয়েশনে সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে বিমান কর্তৃপক্ষ জুনিয়র পাইলটদের বেশ কয়েকজনকে বেতনই দেয়নি, ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। একটি সংস্থার প্রধানের মুখে এমন বক্তব্য মানায় না। তিনি বলেন, নবীন ফার্স্ট অফিসার যাঁরা কেবল চাকরিজীবন শুরু করেছেন, তাঁদের বিমান ফার্স্ট অফিসার হিসেবে স্বীকার করতে চাচ্ছেন না। দীর্ঘ সময় তাঁদের কোনো বেতন দেওয়া হয়নি।

এদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কর্তন ও ভাতা বন্ধ করলেও বিমান কর্তৃপক্ষ লভ্যাংশ শেয়ার করার কথা ভাবছে। গত ২৪ জানুয়ারিতে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সর্বশেষ সভা হয়। সেখানে আলোচনা ওঠে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের লভ্যাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে শেয়ার করার। ওই সভায় বিমানের একজন সদস্য প্রশ্ন তোলেন, ‘যেখানে সবার বেতন দিতে পারছেন না, সেখানে লাভ শেয়ার করার প্রশ্ন আসে কী করে?’

এই দিকটির কথা ইঙ্গিত করে বিমানের এক জ্যেষ্ঠ পাইলট প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক দিকে বিমান বেতন কাটছে। আরেক দিকে মুনাফা বোনাস দিতে চাচ্ছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বিমানের কাছে টাকা আছে। কিন্তু তারা কর্মীদের পুরো বেতন দিতে চায় না।’

এ বিষয়ে কথা হয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সময়ে পাইলটরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁদের প্রতি আমরা অনেক কৃতজ্ঞ। ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা কাজ করেছেন। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বিমান খুব বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে না গেলেও সময়টা বেশ খারাপ গিয়েছে।’ মাসখানেকের মধ্যে পাইলটসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কর্তনবিষয়ক সমস্যা সমাধান হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।