করোনায় সংকটে প্রতিবন্ধী নারীরা

দেশে ৮০ লাখ প্রতিবন্ধী নারী বৈষম্যের শিকার। করোনাকালে আরও বেড়েছে এই বৈষম্য।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন
ছবি : প্রথম আলো

করোনাকালে নারী প্রতিবন্ধীরা আরও বেশি বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন আলোচকেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার এক ভার্চ্যুয়াল সংলাপে বক্তারা বলেন, সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষেত্রে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবারও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুসারে তালিকা না থাকায় সরকারি সহায়তা যথাযথভাবে পৌঁছায়নি নারী প্রতিবন্ধীদের কাছে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী শব্দটির পরিবর্তে প্রতিবন্ধিতা রয়েছে ব্যক্তিদের ‘ভিন্নভাবে সক্ষম’ বলার ওপর জোর দিয়েছেন বক্তারা।

ইনক্লুসিভ ফিউচার, ইউকে এইডের সহযোগিতায় ‘জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য ও প্রতিবন্ধী নারীর অবস্থান: কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপট’ শিরোনামে ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলের আয়োজন করে যৌথভাবে লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড, উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট (ডব্লিউডিডিএফ), সিবিএম ইন্টারন্যাশনাল, সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) ও প্রথম আলো।

কোভিড-১৯-এর মতো দুর্যোগ আরও আসতে পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে হয়, সে শিক্ষা দিয়েছে কোভিড। তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় একে অপরের প্রতি অনুভূতিপ্রবণ ও সংবেদনশীল হতে হবে।
আবুল হোসেন, প্রকল্প পরিচালক, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়

অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন। তিনি বলেন, কোভিড-১৯-এর মতো দুর্যোগ আরও আসতে পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে হয়, সে শিক্ষা দিয়েছে কোভিড। তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় একে অপরের প্রতি অনুভূতিপ্রবণ ও সংবেদনশীল হতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সমাজের ইতিবাচক মনোভাব ও আচরণ থাকা দরকার। প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য ঘরে বসে প্রশিক্ষণ ও আয় করার ব্যবস্থা করেছে সরকার। তাঁরা নিজেদের পণ্য বিক্রি করে আয় করে পরিবারে ভূমিকা রাখতে পারেন। তাহলে পরিবারও আর প্রতিবন্ধী নারীকে বোঝা মনে করবে না। তিনি প্রতিবন্ধী নারীদের সহযোগিতায় সরকারের সঙ্গে উন্নয়ন সংস্থা ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।

বেসরকারি সংগঠন নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির
ছবি : প্রথম আলো

বেসরকারি সংগঠন নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, প্রতিবন্ধিতা সবার মধ্যেই কম-বেশি আছে। সবাই সবকিছু পারেন না। ফলে ভিন্নভাবে সক্ষম যাঁরা, প্রতিবন্ধিতার সঙ্গে বসবাস করছেন যাঁরা, তাঁরা লড়াই করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। তাঁদের প্রতি সম্মান জানানো উচিত। প্রত্যেকের দায়িত্ব হচ্ছে, যার যার জায়গা থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সব ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ তৈরি করা। কোভিড পরিস্থিতিতে নারীরা নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। প্রতিবন্ধী নারীরা আরও বেশি শিকার হচ্ছেন।

সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্টের (সিডিডি) নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান খান বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশের নারীদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের পাশাপাশি বিপরীত চিত্রও রয়েছে। ৭০ শতাংশের বেশি নারী বৈষম্যের শিকার। এর মধ্যে ৮০ লাখ প্রতিবন্ধী নারী আরও বেশি বৈষম্যের শিকার। কোভিডে এই বৈষম্য আরও বেড়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের লালন-পালন করেন, যত্ন নেন এমন মানুষের মধ্যে ৯৫ শতাংশ মা। সংখ্যার হিসাবে যা প্রায় দেড় কোটি। প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে অন্যের দোষারোপের মধ্য দিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হয় তাঁদের।

একজন নারী একবার নারী হিসেবে আরেকবার প্রতিবন্ধী হিসেবে বৈষম্যের শিকার হন। এর শুরু হয় পরিবার থেকে, যা রাষ্ট্রও ধারণ করে
তানিয়া হক, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ

প্রতিবন্ধী শব্দের পরিবর্তে ‘ভিন্ন ধরনের সক্ষমতা’ শব্দ ব্যবহারের ওপর জোর দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে ওই ব্যক্তিকে অক্ষম বুঝিয়ে কতগুলো নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের অক্ষমতা যে তাঁদের ভিন্ন ধরনের সক্ষমতা চিহ্নিত করতে পারি না। একজন নারী একবার নারী হিসেবে আরেকবার প্রতিবন্ধী হিসেবে বৈষম্যের শিকার হন। এর শুরু হয় পরিবার থেকে, যা রাষ্ট্রও ধারণ করে।’

সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্টের (সিডিডি) নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান খান
ছবি : প্রথম আলো

লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ডের ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন অ্যাডভাইজার মুরালি পদ্মানাভান বলেন, জেন্ডার ও প্রতিবন্ধিতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সামাজিক অবস্থান ও জেন্ডারের ওপর প্রতিবন্ধিতা ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যেকোনো কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।

বৈষম্য দূর করতে প্রথমে নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদায় নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা, রাজনীতি, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে সব খাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
মুহাম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা ,প্রতিনিধি ,সিবিএম ইন্টারন্যাশনাল

সিবিএম ইন্টারন্যাশনালের এদেশীয় প্রতিনিধি মুহাম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা বলেন, বৈষম্য দূর করতে প্রথমে নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদায় নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা, রাজনীতি, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে সব খাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, কোভিডকালে প্রতিবন্ধী নারীরা সংকটের মধ্যে রয়েছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরাসরি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছে ডিজিটাল ব্যবস্থায় সহযোগিতা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
করোনাকালে প্রতিবন্ধী নারীদের সমস্যার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিবিএম ইন্টারন্যাশনালের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তাজিন হোসেন এবং ডব্লিউডিডিএফের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন্নাহার মিষ্টি। তাঁরা জানান, করোনাকালে নারী প্রতিবন্ধীরা খাদ্যসংকটে ভুগেছেন। সরকারি সহায়তা পৌঁছায়নি। অনেকে শ্বশুরবাড়ি ও নিজ পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ ত্রাণ নিতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক
ছবি : প্রথম আলো

উইমেন অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লিউডিডিএ) সাধারণ সম্পাদক জাহান আরা হেনা তাঁর এলাকা চট্টগ্রামে প্রতিবন্ধী নারীদের সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, সমতল এলাকার চেয়ে পাহাড়ি এলাকায় প্রতিবন্ধী নারীরা আরও কষ্টে থাকেন। পরিবারও কখনো কখনো তাঁদের কথা অগ্রাহ্য করে।

প্রতিবন্ধী নারীদের জাতীয় পরিষদের (এনসিডিডব্লিউ) সভাপতি নাসিমা আক্তার বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী কোনো তালিকা নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সহযোগিতা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হন।

লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ডের ন্যাশনাল ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন কর্মকর্তা নুসরাত আইরিন বলেন, নির্যাতনের শিকার প্রতিবন্ধীরা নারীরা কোথায় গেলে আইনি সহায়তা পাবেন সেটাও বুঝে উঠতে পারেন না।

অনুষ্ঠানটি সাংকেতিক ভাষায় প্রকাশ করেন আরাফাত সুলতানা লতা। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।