কর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না হেফাজতের

হেফাজতে ইসলামের মূল কর্মী-সমর্থক কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা। তাঁরা আগের মতো নেতাদের কথা শুনছেন না।

হেফাজতের ডাকা হরতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সুরসম্রাট আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনে আগুন দেওয়া হয়। গত রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও হরতালকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হয়েছে, তাতে নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না হেফাজতে ইসলামের। সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের দাবি, আন্দোলনের বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সাংগঠনিক কোনো নির্দেশনা ছিল না।

হেফাজত নেতারা বলছেন, সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয় ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় মোদিবিরোধী বিক্ষোভে সরকারি দল ও পুলিশের হামলার ঘটনা থেকে। ঢাকায় হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসার ছাত্ররা মিছিল বের করে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন। হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রাণহানি ঘটে গেলে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়, যা আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।

তবে হেফাজতের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে এমন সূত্রগুলো বলছে, এবারের সহিংস ঘটনায় এটাও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে হেফাজতের সমর্থক কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা আগের মতো সংগঠনের নেতাদের কথা সেভাবে শুনছেন না। যার বড় উদাহরণ চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। হাটহাজারী মাদ্রাসা হেফাজতের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সংগঠনের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী এখানকার শিক্ষক। ২৬ মার্চ হাটহাজারীতে মাদ্রাসার ছাত্রদের বিক্ষোভ, সংঘাত, হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। সেখানে সংঘাতে চারজন মারাও গেছেন। সেদিন রাতে মাদ্রাসার মাইকে আহ্বান জানানোর পরও ছাত্ররা রাস্তা ছাড়েননি।

সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে রেলস্টেশন, থানা, প্রেসক্লাবসহ বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, বাড়ি, গাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়। তিন দিনে প্রাণহানি হয় ১২ জনের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজতে ইসলামের একজন দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে বলেন, অতীতের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারীতে বেশির ভাগ সময় আন্দোলন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এ দুটি এলাকায় এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে সহিংসতা করে পার পাওয়া যায়। এ কারণে বারবার একই রকম ঘটনা ঘটে। বেশির সময়ই তাদের লক্ষ্যবস্তু হয় সরকারি স্থাপনা।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনের দিন হেফাজতে ইসলাম সারা দেশে তাণ্ডব চালায়। এর মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

হেফাজতের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান নীতিগত। তাঁদের বিবেচনায় মোদি ‘ইসলাম ও মুসলমানবিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত। তাই গত বছর মুজিব বর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যখন তাঁর বাংলাদেশে আসার কথা ছিল, তখনো তাঁরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছর অনুষ্ঠান হয়নি। কিন্তু এবারের সফরের প্রতিবাদের জন্য হেফাজত সেভাবে প্রস্তুত ছিল না। এ বিষয়ে সংগঠনের উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরাও অংশ নিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলাম বড় কোনো ​কর্মসূচিতে যেতে চায়নি।

যদিও হেফাজতে ইসলামের নেতাদেরই একটি অংশ, যাঁরা ‘সমমনা ইসলামী দলসমূহ’-এর ব্যানারে মোদির আগমনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। তাতে হেফাজতের কেন্দ্রীয় আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদি যুক্ত ছিলেন না।

হেফাজতের নেতাদের দাবি, ২৬ মার্চ ঢাকায় তাঁদের কর্মসূচি ছিল না। তাহলে ওই দিন জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররমে কাদের মিছিল ছিল? এ প্রশ্নের জবাবে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মামুনুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন কারও কর্মসূচি ছিল না। স্বতঃস্ফূর্ত মানুষই করেছে। কিন্তু ঘটনা তো ঘটাইছে সরকারি দলের লোকেরা।’

তাহলে আপনি বায়তুল মোকাররমে কেন গিয়েছিলেন? জবাবে মামুনুল হক ​বলেন, ‘যখন গন্ডগোল চলছিল, তখন অনেক ছাত্র-মুসল্লি মসজিদের ভেতরে আটকা পড়েন। পুলিশ চাচ্ছিল তাদের বের করতে। কিন্তু পারছিল না। তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাকে ফোন করে সহযোগিতা চাওয়া হয়, আমি যাতে বের করে নিয়ে আসি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় সংঘর্ষের জের ধরে হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘাত ও প্রাণহানির পর হেফাজত সাংগঠনিকভাবে ঘটনায় যুক্ত হয়। তারা ২৬ মার্চ রাত আটটায় পরদিন শনিবার সারা দেশে বিক্ষোভ ও রোববার হরতালের কর্মসূচি দেয়। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মুনির হো​সাইন কাসেমীর ভাষ্য, ‘যখন আমাদের লোকদের শহীদ করা হয়, তখন বাধ্য হয়ে আমরা কর্মসূচি দিয়েছি।’

ঢাকায় মোদিবিরোধী প্রথম বিক্ষোভ হয় ১৯ মার্চ। ছয়টি দলের মোর্চা ‘সমমনা ইসলামি দলসমূহ’ বায়তুল মোকাররম থেকে এ বিক্ষোভ করে। এ মোর্চায় থাকা দলগুলোর নেতাদের অনেকেই আবার হেফাজতের বিভিন্ন পদে আছেন। ফলে হেফাজতের ব্যানারে মোদিবিরোধী আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি না থাকলেও সমমনা ইসলামী দলসমূহের কর্মসূচির কারণে তা আলাদা করা যায় না।

এ মোর্চা ১৯ মার্চ বিক্ষোভের পর মোদির ঢাকা সফরের প্রতিবাদে ২৬ মার্চ আবার বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিলে তাদের ডেকে পাঠান ঢাকার মহানগর পুলিশ কমিশনার। তিনি ২৬ মার্চ কর্মসূচি না দিতে নেতাদের অনুরোধ করেন। এ পর্যায়ে সমমনা ইসলামী দলসমূহ ২৫ মার্চ বায়তুল মোকাররমে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এর আগে ২২ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতের নেতা মাওলানা মামুনুল হক ঘোষণা দেন, হেফাজত কোনো কর্মসূচি দেবে না। মোদির আগমনের প্রতিবাদে ওই দিন তাঁরা সারা দেশে ‘ঘৃণা দিবস’ পালন করবেন।

সংগঠনের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, মোদিবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে হেফাজতের নেতাদের সবার মধ্যে সেভাবে আগ্রহ ছিল না। এমনকি পরে হরতালের কর্মসূচি ঘোষণার সময় সংবাদ সম্মেলনে ঢাকায় থাকা হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী উপস্থিত হননি। তাঁকে আনতে গাড়ি পাঠানো হলেও তিনি রাস্তায় সমস্যার কথা জানিয়ে আসেননি। শেষে নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারীতে পরিকল্পিতভাবে হামলা হয়েছে বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, নাশকতামূলক এসব হামলায় কেবল হেফাজত নয়, এর সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত যুক্ত ছিল।

তবে আবদুর রব ইউসুফী গতকাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘ঘটনাটি আমাদের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এসে পড়েছে। যার উৎ​পত্তি করে সরকার দলীয় লোকেরা। আবার সরকারই এ ঘটনায় লাভবান হলো।’

আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির করে গত বছরের নভেম্বরে হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি হয়। এরপর কার্যত হেফাজতের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। এর মধ্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি মাত্র সভা হয়। ওই সভার পর গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি ঘোষণা হয়। মাঝে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ‘ইসলাম অবমাননার’ অভিযোগে এবং ঢাকায় ভাস্কর্যবিরোধিতায় হেফাজতের নেতাদের

তৎ​পর হতে দেখা যায়। যদিও সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন থেমে যায়। এখন মোদিবিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় আবার বিতর্কে হেফাজতে ইসলাম।