কল্পনাকে হার মানানো আলপনা

>

তাঁরা সফল হয়েছেন কৃষিতে, তাঁদের উদ্ভাবনী ক্ষমতায় দেশও পেয়েছে সাফল্য। দুই সফল কৃষকের কাহিনি

নিজের সবজিখেতে সাতক্ষীরার কৃষক আলপনা রানী। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি
নিজের সবজিখেতে সাতক্ষীরার কৃষক আলপনা রানী। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি

বাড়িতে ঢোকার আগেই রাস্তার বাঁ পাশে শিমবাগানের বিস্তার। সেদিকে আঙুল তুলে আলপনা রানী জানালেন, ওখানে মোট আঠারো প্রজাতির শিম চাষ হচ্ছে। তবে চিরাচরিত উপায়ে নয়। পানির ওপর মাচা তৈরি করে তাতে বিশেষ এক পদ্ধতিতে।
ছোট বাঁশের গেট ঠেলে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। চারদিকে সবুজের সমারোহ। ডানে-বাঁয়ে কয়েক কদম এগোতেই দেখতে পাই নানা জাতের লাউ, ঝিঙে, তুরুল, করলা, চালকুমড়া, শসাসহ হরেক প্রজাতির সবজি। কচুর মুখী থেকে শুরু করে কচু, ওল, চাষি আলু, ঢ্যাঁড়স, পেঁপে, বরবটি। কী নেই!
সবজিখেতে বাহারি শাকসবজি তো আছেই। আরও আছে আতা, আপেল, কমলা, বেদানা, কামরাঙা, চেরি, আমলকী, করমচা, জামরুলের মতো নানান ফলদ গাছ। আছে বনজ ও ঔষধি গাছ। যেন গাছের মেলা বসেছে বাড়ির আঙিনার ছোট্ট ওইটুকু পরিসরের ভেতরে।
আলপনা রানীর সবজিবাগানের ভেতরে ঢোকার পর আবারও বিস্ময়। সবজি আর ফলমূলের পাশে আছে ঔষধি জাতের নানান রকমের লতাপাতা—থানকুনি, আদাবরুনি, নিমে শাক, তেলাকুচো, গিলে শাকসহ কত না শাকের বাহার।
মাত্র ৩৩ শতক জমির ওপর ছোট ছোট দুটি বসতঘর আর উনুনের জায়গাটুকু বাদ দিয়ে অবশিষ্ট জায়গাজুড়ে আলপনা রানী গড়ে তুলেছেন তাঁর স্বপ্নঘেরা ‘আমাদের কৃষিবাড়ি’।
আলপনা স্বামীগৃহে এসেছিলেন মাত্র পনেরো বছর বয়সে। আসার পর মানুষের বাড়ি বাড়ি কামলার কাজ করেছেন। গরুর গোবর কুড়িয়েছেন। দিনমজুর স্বামীর সঙ্গে মিলে সংসারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন। অনেক সময় কাজ না মিললে কুড়ানো গোবর শুকিয়ে তৈরি জ্বালানি বিক্রি করেও সংসার চালাতে সাহায্য করেছেন।
শুরুর সেসব দিনের অভাব জয় করে আলপনার এখন সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে। দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে রঞ্জনকে স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখা করানোর পাশাপাশি ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র মেয়ে নিপা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। আর স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে পৈতৃক সম্পত্তিতে গড়ে তুলেছেন ‘আমাদের কৃষিবাড়ি’।
কথা বলার সময় আলপনার দু চোখভরা স্বপ্নপূরণের তৃপ্তি। সবজি চাষে তাঁর হাতেখড়ি বিয়ের আগে, বাবার বাড়িতে। অভাবের কারণে বাবার সঙ্গে মিলে বসতঘর লাগোয়া পতিত জমিতে কিশোরী বয়স থেকেই সবজি চাষ করতেন তিনি।
সম্পত্তি ভাগ-বণ্টনের পর আলপনার স্বামী গঙ্গাধর মিস্ত্রির ভাগ্যে জোটে বাবার ৩৩ শতক জমি। বসতঘরের জমিটুকু ছাড়া বাকি অংশে আমন মৌসুমে ধান চাষ শুরু করেন তাঁরা। পাশাপাশি সংসার চালাতে করতেন দিনমজুরি। সংসারের প্রয়োজনে আলপনাকেও অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে হতো। কখনো মাঠে গৃহস্থের গরু চরানোর কাজ। পারিশ্রমিক কিছু পাওয়া যেত। উপরি পাওনা ছিল গোবর। কিন্তু তাতে কি আর অভাব ঘোচে? শেষমেশ ২০১০ সালে ধান ওঠার পরপরই জমিতে সবজির চাষ শুরু করেন আলপনা। প্রথম বছরেই আশার আলোর দেখা মেলল। এতে উৎসাহ গেল বেড়ে। ফলে পরের দুই বছর ধান ওঠার পরপরই একই জমিতে আবার তাঁরা সবজি চাষ করলেন। এবার সামান্য হলেও অভাব ঘুচল। ২০১২ সালে নানা চিন্তাভাবনা করে নিচু জমিটুকুতে ধান চষলেন তাঁরা। আর অবশিষ্ট জমিটুকুতে আলপনা শুরু করলেন নানান জাতের সবজি চাষ।
এরপর আর থামাথামি নেই। কেবলই সামনে এগিয়ে যাওয়ার গল্প আলপনাদের। স্বামী-স্ত্রী দুজনের প্রচেষ্টায় অল্প দিনের মধ্যেই দাঁড়িয়ে যায় আলপনার স্বপ্নের ‘আমাদের কৃষিবাড়ি’। এসব কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে আলপনা রানী শ্যামনগর উপজেলা ও সাতক্ষীরা জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ২০১৪ সালে পেয়ে যান জাতীয় কৃষি পদক। বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হন ২০১৫ সালে।
নিজের খামারবাড়ির সবজিখেতের প্রয়োজনীয় সারের অভাব পূরণের জন্য কৃত্রিম সারের ওপর আলপনা মোটেই নির্ভর করেন না। ছয়টি গরু পালছেন তিনি। একদিকে তাতে আয় হচ্ছে। আর গরুর গোবর দিয়ে জৈব সার তৈরি করে নিজের সবজিবাগানের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন।
সার বা কীটনাশকের ক্ষেত্রেও আলপনার একই নিদান। নিজের সবজিবাগানে কিংবা ধানের খেতে কোথাও তিনি কোনো কৃত্রিম সার বা কীটনাশক ব্যবহার করেন না। নিজের বাড়িতে মেহগনির ফল আর নিম পাতা সেদ্ধ করে তাতে কেয়া পাউডার মিশিয়ে ধান কিংবা সবজিবাগানের কীটনাশকের চাহিদা মেটাচ্ছেন। ওসব দিয়েই বালাইনাশকের কাজ করছেন।
আলপনার স্বামী গঙ্গাধর মিস্ত্রি জানালেন, শুরুতে তাঁরা বাজারের কৃত্রিম সারই ব্যবহার করতেন। কিন্তু আলপনাই তাঁকে ভিন্ন একটি পরামর্শ দেন। আলপনার পরামর্শ ও পরিশ্রমে এখন তাঁরা বাড়িতে জৈব সার তৈরি করছেন। নিজেদের খামারের চাহিদা মিটিয়ে বাইরে বিক্রি করার জন্য অতিরিক্ত সারও থেকে যায়।
আলপনার সবজিখেতের আয়তন ধীরে ধীরে অনেকটাই বেড়ে গেছে। আরও বড় করার জন্য পাশের মালিকের জমি ইজারা নিয়ে চেষ্টা করছেন। সবজি চাষে অভূতপূর্ব সাফল্যের পর এখন বসতঘরের পাশে লেয়ার মুরগির খামার করারও পরিকল্পনা করছেন।
আলপনাকে নিয়ে গ্রামবাসীদেরও অনেক গর্ব। একই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সামসুর রহমানের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, আলপনা কেবল সবজি চাষ করেই ক্ষান্ত দেননি। আশপাশের গ্রামের মেয়েদের নিয়ে ২০১৩ সালে কৃষিভিত্তিক সংগঠন ‘ধুমঘাট শাপলা নারী উন্নয়ন সংগঠন’ গড়ে তুলেছেন। এ সংগঠনের সদস্য ৬০ জন। গ্রামের মেয়েদের এগিয়ে নিতে সংগঠনটি কাজ করছে।
সংগঠনের সদস্য অন্তাখালী পল্লির কবিতা রানী আলাপে আলাপে পঞ্চমুখে আলপনার সুনাম গাইলেন। বললেন, তিনি অসাধ্যকে সাধন করেছেন। সামান্য ঘুঁটেকুড়ানি থেকে তিনি এখন গ্রামীণ নারীদের পারিবারিক সচ্ছলতার পথপ্রদর্শক। সবার কাছে আদর্শ নারীর প্রতীক।
পতিরাম মণ্ডল ধুমঘাট পল্লির কৃষক। তিনি বললেন, আলপনা দেখিয়ে দিয়েছেন কতটা ইচ্ছাশক্তি আর মনোবল থাকলে অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব। আলপনাকে দেখে তাঁর স্ত্রীও নাকি বাড়িতে দুই বছর ধরে শাকসবজির চাষাবাদ শুরু করেছেন। আলপনার কাছ থেকে তাঁরা নানা প্রজাতির সবজির বীজ সংগ্রহ করেন, বিনা মূল্যে।
ধুমঘাট পল্লির কোমল লতা, শ্রীফলকাঠির আমেনা বিবি, অষ্টমী মণ্ডল, পতিরাম কিংবা অন্তাখালীর রেবেকাই নন, আশপাশের নানা গ্রামের বহু নারী এখন আলপনাকে আদর্শ মেনেছেন। তাঁর পথ অনুসরণ করে নিজেদের এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছেন। নিজেদের বাড়িতে বাড়িতে তাঁরা গড়ে তুলেছেন সবজিবাগান বা কৃষিখামার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শ্যামনগর উপজেলা কর্মকর্তা আবুল হোসেন মিয়া বললেন, শাকসবজি চাষে আলপনা এ অঞ্চলে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। স্থানীয় কৃষকদের বিনা মূল্যে বীজ দিচ্ছেন, দিচ্ছেন পরামর্শও। এ ছাড়া হারিয়ে যাওয়া শাকসবজির বীজ সংরক্ষণ করে মানুষকে সেসব নতুন করে চেনাচ্ছেনও।
আলপনার কৃষিখামারে এখন সব মিলিয়ে তিন শর মতো প্রজাতির শাকসবজি। তাঁর স্বপ্ন, সবজি চাষের সফলতা দিয়ে মানুষকে তিনি রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ধুমঘাট নতুন করে চেনাবেন।
কল্যাণ ব্যানার্জি: প্রথম আলোর সাতক্ষীরা প্রতিনিধি।

কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য
আলু উৎপাদনে এশিয়ায় তৃতীয়
স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ
আম উৎপাদনে সপ্তম
পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম
১৯৭১ থেকে ২০১৫
ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ৭৫৭ গুণ
গমের উৎপাদন বেড়েছে ১২ দশমিক ২৫ গুণ
সবজির উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণ
ধান চাষের জমি ১৮ শতাংশ কমলেও উৎপাদন বেড়েছে ৩ দশমিক ১৬ গুণ
ফলের উৎপাদন বাড়ার হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ
সূত্র: বিবিএস, কৃষি মন্ত্রণালয়, এফএও, ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার’ (২০১৬)