
গ্রামের সবাই জানে রাশেদ আলী শুধুই একজন দিনমজুর কিশোর। কেউ কখনো জিজ্ঞাসাও করেনি সে পড়ালেখা করে কি না? সেই রাশেদই সবাইকে অবাক করে দিয়েছে এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন।
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে তাঁত কারখানায় সুতা তোলার কাজ করে রুমি খাতুন। এ কারণে ঠিকমতো স্কুলে যেতেও পারত না সে। এর মধ্যেই জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। সেই রুমি এসএসসিতেও তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে।
নাটোরের লালপুর উপজেলার মঞ্জিলপুকুর উচ্চবিদ্যালয়ের কারিগরি বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে রাশেদ। সে উত্তর লালপুর গ্রামের সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যাওয়া মন্টু আলীর ছেলে। রুমি সিরাজগঞ্জ পিডিবি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের নতুন ভাঙ্গাবাড়ী মহল্লার মৃত রকিবুল ইসলামের মেয়ে। কষ্টের জীবনে তাদের সফলতার এমন গল্প স্বপ্ন দেখাচ্ছে তাদের পরিবারকে।
স্কুল ছাড়তে হয়েছিল রাশেদকে: রাশেদের বাবা দুই বছর আগে পঙ্গু হওয়ার পর থেকে দোকান করেন। মা রোকেয়া বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তাতেও সংসার চলে না। দিনমজুরি করে রাশেদই সংসার সচল রেখেছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে। সপ্তম শ্রেণিতে বেতন পরিশোধ করতে না পারায় তাকে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে মঞ্জিলপুকুর উচ্চবিদ্যালয়ে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পায় সে।
রাশেদের বাবা মন্টু আলী বলেন, ‘রাশেদ এসএসসিতে প্রতিটি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এর বেশি কিছু আমার জানা নাই।’
মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার পর ভাবিছিনু ওর পড়ালেখা আর হবে না। আমাদের না জানিয়ে সে মঞ্জিলপুরে স্কুলে ভর্তি হয়।’
রাশেদ আলী জানায়, দিনমজুরি করা ছাড়া তার সামনে কোনো রাস্তা ছিল না। সে সুযোগ পেলে কারিগরি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে প্রকৌশলী হতে চায়।
প্রধান শিক্ষক হাশেম আলী বলেন, নিয়মিত ক্লাস না করলেও সে শিক্ষক ও সহপাঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। সুযোগ পেলে সে আরও ভালো করবে।
সুতোয় মোড়া জীবন রুমির: রুমির বাবা ১২ বছর আগে মারা যান। ছোট একটা জমির ওপর টিনের ঘরে তাদের বাস। মা মোমেনা বেওয়া তাঁত কারখানায় নলিতে সুতা ভরে যা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই মায়ের সঙ্গে সুতার কাজ করে সে।
রুমির মা মোমেনা বেওয়া বলেন, ‘ঠিকমতো ক্লাসে যেতে পারেনি ও। কষ্ট করেই ভালো ফল করেছে রুমি। তবে এত ভালো করবে বুঝতেই পারিনি। এখন চিন্তা করছি ভবিষ্যৎ লেখাপাড়া নিয়ে। কীভাবে সামনের দিনগুলো পাড়ি দেব।’
রুমি খাতুন জানায়, ‘দিনের বেলায় সুযোগ কম থাকায় রাতে বেশি লেখাপড়া করেছি। প্রাইভেট পড়তে না পারলেও সহপাঠীদের সাহায্য নিয়ে বাড়িতেই পড়েছি। খেয়ে না খেয়ে স্কুলে গিয়েছি। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। জানি না এই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, রুমি অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় তাকে বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক অন্য চোখে দেখত। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতা পেলে সে ভবিষ্যতে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে।