কাউন্সিলর তারেকুজ্জামানের একটি গাড়ি জব্দ, দুটি নজরদারিতে

কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের মালিকানাধীন এই গাড়িটি জব্দ করেছে দুদক। ছবি: দুদকের সৌজন্যে
কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের মালিকানাধীন এই গাড়িটি জব্দ করেছে দুদক। ছবি: দুদকের সৌজন্যে

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের একটি গাড়ি জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁর মালিকানাধীন আরও দুটি গাড়ি নজরদারিতে রাখার জন্য মোহাম্মদপুর থানা–পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার সংস্থার সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুদকের একটি দল এসব ব্যবস্থা নেয়। দুদক সূত্র প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। রাজীবের বিরুদ্ধে করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে দুদক এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

দুদক জানিয়েছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার তিন রাস্তার মোড়ে একটি গাড়ির গ্যারেজ থেকে একটি গাড়ি জব্দ করে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। নীল রঙের ওই গাড়িটি সেবা অটোমোবাইল নামের একটি গ্যারেজে সার্ভিসিংয়ের জন্য রাখা হয়েছিল বলে দুদক জেনেছে। গোপন সূত্রে তথ্য পেয়ে গাড়িটি জব্দ করে দুদক।

রাজীবের অন্য দুটি গাড়িও ওই গ্যারেজের সামনে পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি গাড়ি নম্বরবিহীন ভাঙাচোরা অবস্থায় ছিল। আরেকটি গাড়ি ভালো অবস্থায় থাকলেও ব্যাটারির কারণে চালু হচ্ছিল না। গাড়ি দুটিতে নজরদারি করার জন্য মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেছে দুদক।

চলমান শুদ্ধি অভিযানে গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার একটি বাসা থেকে তারেকুজ্জামান রাজীবকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা হয়।

এরপর ৬ নভেম্বর রাজীবের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। অনুসন্ধানে রাজীবের ৭ বাড়ি ও ৮ গাড়ির সন্ধান পায় সংস্থাটি। এ ছাড়া তাঁর মোট ২৬ কোটি ১৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে দুদক।

রাজীবের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তাঁর কয়েক শ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তের সময় প্রমাণ সাপেক্ষে ওই সব সম্পদের তথ্য আইন–আমলে নেওয়া হবে।

মামলার এজাহারের তথ্য অনুসারে, রাজীব তাঁর চাচা ইয়াসিন হাওলাদারের নামে প্রায় ১২ কোটি টাকা সম্পদ কিনেছেন। তাঁর ওই চাচা পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। এ ছাড়া রাজীবের বিলাসবহুল আটটি গাড়ির সন্ধান পেয়েছে, যেগুলোর দাম অন্তত ১২ কোটি টাকা। দুদক বলছে, কাউন্সিলর হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে ২৬ কোটি ১৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকার স্থাবর–অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন রাজীব। এসব অর্থ আয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো উৎস পায়নি দুদক। এ ছাড়াও রাজীবের আরও সম্পদের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে, যেগুলো তদন্তকালে আইন আমলে নেওয়ার কথা বলেছেন দুদক কর্মকর্তারা।

এজাহারের তথ্যমতে, রাজীব কাউন্সিলর হিসেবে নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি অবৈধভাবে অর্জন করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ১ নম্বর সড়কে ৩৩ নম্বর প্লটে একটি দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে। এতে প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।

কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের মালিকানাধীন এই গাড়িটি জব্দ করেছে দুদক। ছবি: দুদকের সৌজন্যে
কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের মালিকানাধীন এই গাড়িটি জব্দ করেছে দুদক। ছবি: দুদকের সৌজন্যে

মোহাম্মদপুরের কাটাসুরের ৩ নম্বর সড়কে ৬০ লাখ টাকায় নিজের নামে প্লট কিনেছেন রাজীব। মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের ৬ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় পশ্চিম-দক্ষিণ পাশের বেড়িবাঁধ প্রধান সড়কের ‘দক্ষিণা হাওয়া’ নামে পাঁচতলা বাড়িটির মালিক ইয়াছিন হাওলাদার, রাজীবের চাচা। ওই সম্পত্তির প্রকৃত মালিক রাজীব, যেখানে তাঁর প্রায় ২ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। রাজীব তাঁর চাচার নামে বাড়িটি কিনে নিজ ভোগদখলে রেখেছেন।

মোহাম্মদপুরের চানমিয়া হাউজিংয়ের ২ নম্বর সড়কে তিনতলা বাড়ি রাজীবের চাচা ইয়াছিন হাওলাদারের নামে হলেও তাতে রাজীবের বিনিয়োগ এক কোটি টাকা। মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ হাউজিংয়ের ৪/বি সড়কে ইয়াসিন হাওলাদারের নামে আরেকটি বাড়ি আছে, যাতে রাজীবের বিনিয়োগ দেড় কোটি টাকা। মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ হাউজিংয়ের ৫ নম্বর সড়কের চারতলা বাড়িটিও ইয়াসিন হাওলাদারের নামে। এতে রাজীবের বিনিয়োগ দেড় কোটি টাকা। একইভাবে মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের বেড়িবাঁধ প্রধান সড়কের ৬ নম্বর বাড়িও রাজীবের চাচার নামে। এতে রাজীবের বিনিয়োগ ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তারেকুজ্জামান রাজীব সিলিকন হাউজিংয়ের শেয়ার হোল্ডার এবং শ্যামলাপুর ওয়েস্টার্ন সিটি লিমিটেডের পরিচালক। অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ৬ নম্বর সড়কে প্রায় ৬ কাঠা জমি ব্যাডমিন্টন খেলার মাঠ হিসেবে দখল করে রেখেছেন রাজীব। সেখানে প্রায় ৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

এজাহারে রাজীবের চাচা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ইয়াছিন হাওলাদার পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি ছিলেন। এর বাইরে তাঁর আয়ের কোনো উৎস ছিল না, যদিও তিনি বর্তমানে নিজেকে একজন ঠিকাদার হিসেবে পরিচয় দেন। রাজীব নিজের নামে ও তাঁর চাচা ইয়াছিন হাওলাদারের নামে প্রায় ১১ কোটি ৯০ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। সেটা নিজের দখলে রেখে ভাড়াসহ অন্যান্য সুবিধা নিয়েছেন। তিনি এসব সম্পদের তথ্য আয়কর নথিতে দেখাননি। এর পক্ষে তাঁর আয়ের কোনো বৈধ উৎস নেই।

অনুসন্ধানের সময় রাজীবের আয়কর নথি ও অন্যান্য রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দুদক দেখেছে, রাজীবের নামে ১২ কোটি ১৪ লাখ ৪ হাজার ৬০০ টাকার অস্থাবর আছে। এর পক্ষেও তাঁর কোন সুনির্দিষ্ট বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি।
তারেকুজ্জামান রাজীবের দখলে নামে-বেনামে অর্জিত মোট আটটি গাড়ি পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান দল। এসব গাড়ির দাম আনুমানিক ১১ কোটি ৯০ লাখ ৯১ হাজার টাকা।

বাংলাদেশে ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া রেকর্ডপত্রে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে রাজীবের জমা আছে ১ কোটি ১২ লাখ ৩১ হাজার ৩০৫ টাকা।
সব মিলিয়ে রাজীবের ২৬ কোটি ১৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯০৫ টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে দুদক।

এজাহারে আরও বলা হয়, বিভিন্ন সূত্রে রাজীবের আরও বাড়ি, ফ্ল্যাট–প্লট আছে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অনেক সম্পদের একটি বড় অংশ তিনি বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুদকের কাছে তথ্য আছে। এসব বিষয়ে তদন্তকালে আন্তরাষ্ট্রীয় যোগাযোগের মাধ্যমে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হবে। দুদক বলছে, প্রকৃতপক্ষে রাজীবের বৈধ আয়ের উল্লেখযোগ্য কোনো উৎস নেই। তিনি ক্যাসিনো ব্যবসাসহ অবৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থ দিয়ে এসব সম্পদ অর্জন করেছেন।