কাউন্সিলরের মানবতার লড়াই

দলের সদস্যদের সঙ্গে মাকসুদুল আলম খন্দকার

করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গে মৃত ব্যক্তিদের লাশ পড়েছিল বাড়ির আঙিনায়, সিঁড়িতে। সংক্রমণের ভয়ে স্বজন ও প্রতিবেশীরা কেউ লাশ দাফনে এগিয়ে আসেনি। ওই পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাশ দাফন ও সৎকারে এগিয়ে আসেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। মাকসুদুল ও তাঁর দল টিম খোরশেদ একে একে ১৪৪ জনের লাশ দাফন করেন। মৃতদেহ সৎকারে মুখাগ্নি করেছেন কয়েকজনের। করোনার শুরু থেকে হ্যান্ডস্যানিটাইজার তৈরী ও বিতরণসহ নানা উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জবাসীর পাশে ছিলেন আলোচিত এই কাউন্সিলর। আগামীতেও মানবসেবার এই কাজ চালিয়ে যেতে চান তিনি।

রোববার দুপুরে শহরের মাসদাইর কার্যালয়ে তাঁর সাথে প্রথম আলো প্রতিবেদকের কথা হয়। এই কাজ করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা, সহযোগিতাসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন।

চীনে কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর থেকে মার্চের ৯ তারিখ থেকে নারায়ণগঞ্জে করোনা ও ডেঙ্গু সচেতনতায় লিফলেট ও মাস্ক বিতরণ শুরু করেন মাকসুদুল। ১৮ মার্চ তাঁর বন্ধু, সহকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে ৬০ জনের টিম খোরশেদ গঠন করেন। দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর পেয়ে শহরের পাইকারি ওষুধের দোকান কালীরবাজারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার সংগ্রহের যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনো দোকানে হ্যান্ডস্যানিটাইজার পাননি। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন থেকে ফর্মুলা নিয়ে হ্যান্ডস্যানিটাইজার তৈরীর উদ্যোগ নেন তিনি। বিকন ফার্মার ফার্মাস্টিট বন্ধু আসাদুজ্জামান চৌধুরীর দেখানো ফর্মুলায় তা বানাতে শুরু করেন। ৬০ হাজার বোতল হ্যান্ডস্যানিটাইজার তৈরি ও বিতরণ করেন। ১০ হাজার বোতল বাংলা লিকুইড সাবান তৈরি করেন।

মাকসুদুল বলেন, গত ২২-২৩ মার্চ ঢাকায় করোনা ও করোনা উপসর্গে মৃত্যু বাড়ার কারণে অমানবিক ঘটনা ঘটতে থাকে। সংক্রমণের ভয়ে লাশ দাফনে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে। একদিন সবাইকে মরতে হবে, সেই চিন্তা থেকে ইউটিউব ও ফেসবুক ঘেটে আল্লাহ্ ওপর ভরসা রেখে যথেষ্ট নিরাপত্তা নিয়ে লাশ দাফন শুরু করেন। সেই থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে আশঙ্কা করে তিনি লাশ দাফনে উদ্যোগী হন।

মাকসুদুল বলেন, আতঙ্কের কারণে লাশ দেখা হয়নি। পরে ভিডিও ফুটেজ দেখে চিনতে পারেন ওই ব্যক্তি তাঁর কাছের পূর্বপরিচিত। তাঁর পর একের পর এক জেলায় ৮০টি লাশসহ গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা ও করোনা উপসর্গে মৃত মোট ১৪৪টি লাশ দাফন করেন

গত ৭ এপ্রিল প্রথম শহরের জামতলায় করোনা উপসর্গ নিয়ে ৬৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। লকডাউনের কারণে স্বজনেরা দূরে অবস্থান এবং প্রতিবেশীরা কেউ এগিয়ে আসেনি। লাশ বাড়িতেই পড়ে ছিল। ওই ব্যক্তির মেয়ে ফোন করে তাঁর বাবার মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়ে কাউন্সিলর মাকসুদুলকে মুঠোফোনে করেন। তিনি ও তাঁর দলের লোকজন পিপিই পরে লাশ উদ্ধার করে দাফনের ব্যবস্থা করেন।

করোনা উপসর্গে মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনের প্রথম সেই অনুভূতি প্রসঙ্গে মাকসুদুল বলেন, লাশ আনার জন্য পিকআপ ভ্যান নিয়ে যান। করোনা উপসর্গে মারা গেছে জানতে পেরে ওই পিকআপ ভ্যানের চালক গাড়ি ফেলে পালিয়ে যান। পরে তাঁরা ওই বাড়ি থেকে লাশ নিয়ে দাফন করেন।

মাকসুদুল বলেন, আতঙ্কের কারণে লাশ দেখা হয়নি। পরে ভিডিও ফুটেজ দেখে চিনতে পারেন ওই ব্যক্তি তাঁর কাছের পূর্বপরিচিত। তাঁর পর একের পর এক জেলায় ৮০টি লাশসহ গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা ও করোনা উপসর্গে মৃত মোট ১৪৪টি লাশ দাফন করেন। এর মধ্যে ৯টি স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল।

করোনার সংকটের অনুভুতি সম্পর্কে মাকসুদুল বলেন, ‘শহরের আমলাপাড়া এলাকায় গত ১৪ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত একই পরিবারের একাধিক সদস্যের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে। ওই ঘটনায় অনেক ভয় পেয়েছি। বাবা মারা গেছে, ভয়ে সন্তান বা প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসছে না। আমরা যখন তাঁদের পাশে দাঁড়াই তখন ওই পরিবারগুলোর চোখগুলোতে প্রশান্তি দেখতে পাই। এতে আমরা উৎসাহিত হই।’

মাকসুদুল বলেন, ‘অনেকে শুরুতে আমাদের টিপ্পনী কেটে বলেছেন, আমরা আত্মপ্রচারের চেষ্টা করছি। আমাদের উদ্দেশ্যে ছিল ভয় কমানো, সচেতন করা এবং মানুষকে মানবিক কাজে উৎসাহিত করা। আমাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। আমাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।’

করোনার লাশ দাফনের এক পর্যায়ে মাকসুদুল ও তাঁর স্ত্রী আফরোজা আক্তার লুনা করোনায় আক্রান্ত হন। শ্বাসকষ্ট বেড়ে পরিস্থিতি খারাপ হলে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে সেখানে প্লাজমা দেওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন। তখন তিনি রোগীদের প্লাজমা দেওয়ার উদ্যোগ নেন। এ পর্যন্ত তাঁরা ১০৩ জনকে প্লাজমা দিয়েছেন। ১৩২ জনকে দিয়েছেন অক্সিজেন সহযোগিতা। তাঁদের কাছে আছে ৭টি অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং একটি কনসেনট্রেটর রয়েছে।

মাকসুদুল বলেন, অক্টোবর-নভেম্বর চাপ কম ছিল। এখন চাপ বেড়েছে। তবে সংক্রমণ আগের চেয়ে কম। টিম খোরশেদকে সাপোর্ট দিতে মডেল ডি ক্যাপিটাল রোগী ও লাশ বহনে অ্যাম্বুলেন্স, পুষ্টির সহযোগিতার জন্য সবজি, ডিম, বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে গড়ে একজনের মতো লাশ দাফন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যত দিন করোনা সংকট থাকবে, তত দিন তাঁদের এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।

তাঁদের পক্ষ থেকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ ১০ নারীকে সেলাই মেশিন এবং ১০ জনকে বাইসাইকেল দেওয়া হয়েছে টিম খোরশেদের পক্ষ থেকে।

মাকসুদুল বলেন, তিনি শুরু করার পর অনেকেই তাঁকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছেন। তবে তিনি কোনো নগদ আর্থিক সহায়তা তিনি নেন না।

মাকসুদুলের স্ত্রী আফরোজা খন্দকার লুনা প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে তিন মাস তাঁর স্বামী মাকসুদুল আলাদা ছিলেন। মানবিক কাজেই ছিলেন। তিনি বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি মানুষ কত অসহায়। যতদিন করোনা পরিস্থিতি থাকবে, ততদিন খোরশেদ মানুষের পাশে থাকবে—এই উপলব্ধি আমাকে গভীর তৃপ্তি দেয়।’

করোনাকালে কাউন্সিলর মাকসুদুলের মানবিক এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এলাকাবাসীসহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। তাঁর ও উদ্যোগ অভিনন্দিত হয়েছে সারা দেশে।


মুজিবুল হক: প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি