কাজ না করেই তুলে নেওয়া কোটি টাকা ফেরত দিলেন ঠিকাদার

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ১০টি কমিউনিটি সেন্টার ও ৬টি ঘাটলা নির্মাণের কাজ শুরু না করেই বিল বাবদ ১ কোটি ১১ লাখ ১৭ হাজার ৬৩৫ টাকা তুলে নিয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এ বিল তুলে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় গণমাধ্যমে খবর হওয়ার পর সৃষ্ট পরিস্থিতে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঠিকাদার সব টাকা ফেরত দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ ব্যয় নির্বাহের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ করা হয়। ওই বরাদ্দে কলাপাড়া উপজেলায় খাজুরা, চালিতাবুনিয়া, গোড়া আমখোলা, ছোট বালিয়াতলী, ফতেপুর, লক্ষ্মীবাজার, নিশানবাড়িয়া, গামুরিবুনিয়া, নীলগঞ্জ ও নিজশিববাড়িয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য প্রতিটি কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৯ লাখ ৮০ হাজার ১১৩ টাকা। এ ছাড়া নিশানবাড়িয়া ও গামুরিবুনিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুটি ঘাটলা নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৫ টাকা। নীলগঞ্জ ও গোড়া আমখোলাপাড়া আশ্রয়ণের দুটি ঘাটলার নির্মাণ ব্যয়ে বরাদ্দ ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৫ টাকা এবং খাজুরা ও ফাসিপাড়ায় দুটি ঘাটলা নির্মাণ ব্যয় বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৫ টাকা।
প্রকল্পের কাজ শুরু না করেই মেসার্স সারিকা ট্রেডার্স বরাদ্দের মোট ১ কোটি ১১ লাখ ১৭ হাজার ৬৩৫ টাকা ১৩টি বিল ভাউচারের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক গলাচিপা শাখার হিসাব নম্বরে (চলতি-৪৩১০২০০০০১৫০৫) নিয়ে নেয়। প্রকল্প ব্যয়ের বিলের ভাউচারের মাধ্যমে কলাপাড়া উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয় থেকে বরাদ্দের এই টাকা হস্তান্তর হয়।
প্রকল্পের কাজের বিপরীতে বিলে কলাপাড়ার তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুনিবুর রহমান এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) তপন কুমার ঘোষের স্বাক্ষর রয়েছে। তবে দুই কর্মকর্তা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না এবং তাঁদের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই প্রকল্পের কাজ এখনো শুরুই হয়নি। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিরাই এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। চম্পাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রিন্টু তালুকদার বলেন, তিনি এই প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এমনকি ঠিকাদারও তাঁর এলাকায় এ ধরনের কোনো কাজ শুরু করেননি। লতাচাপলী ইউপির চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা বলেন, তাঁর ইউনিয়নে কমিউনিটি সেন্টার ও ঘাটলার কাজ করার জন্য বরাদ্দ আছে, তা-ও তাঁর জানা নেই। আর এ ধরনের কোনো কাজও করা হয়নি।
জানতে চাইলে কলাপাড়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) তপন কুমার ঘোষ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের বরাদ্দ ইউএনও বরাবর আসে এবং বরাদ্দ ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর একার। এখানে পিআইও থেকে শুধু কারিগরি সহায়তা করা হয়। পিআইও আরও বলেন, আসলে তাঁর স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে এবং ভুয়া প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিল নেওয়া হয়েছে।
কলাপাড়ার তৎকালীন ইউএনও মো. মুনিবুর রহমান জানান, তিনি ২২ মার্চ কলাপাড়া থেকে বদলি হয়ে বরিশাল এসেছেন। এ ছাড়া এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো চিঠি কলাপাড়ায় থাকাকালে তাঁর কাছে আসেনি। তিনি বলেন, ‘কর্মস্থল ত্যাগ করার ১৫ দিন পরে আমার স্বাক্ষর জাল করে হিসাবরক্ষণ কার্যালয় থেকে বিল, তা-ও প্রকল্পের ব্যাংক হিসাব ছাড়া সরাসরি ঠিকাদারের হিসাবে হস্তান্তর করার বিষয়টি কীভাবে সম্ভব হলো? শতভাগ জালিয়াতির মাধ্যমে এ কাজ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
কলাপাড়া উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মোতালেব খন্দকার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের শুধু বরাদ্দ আছে কি না এবং ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে কি না, এটাই দেখতে হয়। ঠিকাদার কাজের বিপরীতে বিল জমা দিয়েছেন। এখান থেকে বিল পাস হয়েছে এবং ঠিকাদারের ব্যাংক হিসাবে নিয়ে গেছেন। আমাদের এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।’
মেসার্স সারিকা ট্রেডার্সের মালিক মো. শামীম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু করোনার কারণে কাজ শুরু করতে পারিনি। এ ছাড়া প্রকল্পের টাকা যাতে ফেরত না যায়, এ লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ফোন পেয়ে কাজের বিল জমা দিয়ে বিল তোলা হয়েছিল। যেহেতু কাজ করতে পারিনি, তাই সব টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। সরকারি চালানে প্রকল্পের নামে সোনালী ব্যাংকের গলাচিপা শাখায় পুরো টাকাই জমা দেওয়া হয়েছে।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সারিকা ট্রেডার্স সরকারি চালানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের নামে ১ কোটি ১১ লাখ ১৭ হাজার ৬৩৫ টাকা জমা দিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সোনালী ব্যাংক গলাচিপা শাখার ব্যবস্থাপক মো. ইব্রাহিম মোল্লা।
জানতে চাইলে কলাপাড়ার বর্তমান ইউএনও আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, এই প্রকল্পের অধীনে ১০টি কমিউনিটি সেন্টার ও ৬টি ঘাটলা নির্মাণের কাজ গত ৩১ মার্চের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। মাঠপর্যায়ে গিয়ে জানা যায়, কোনো কাজ হয়নি। গোটা বিষয় জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেনেছি। বিষয়টি অবশ্যই তদন্ত করে দেখা হবে এবং তদন্তে যাঁরা দায়ী বা দোষী হবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’