কাজে দেরির মাশুল হাজার কোটি টাকা

তিন কিলোমিটার দীর্ঘ ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকার এই খাল খনন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে এখন ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়ি নগরের বহদ্দারহাটে। ভারী বৃষ্টি হলেই পানিতে তলিয়ে যায় ওই এলাকা। পানি ঢুকে পড়ে মেয়রের বাড়িতেও। জলাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় কার্যত ঘরবন্দী হয়ে পড়েন মেয়র।

বহদ্দারহাটসহ আশপাশের এলাকার দীর্ঘদিনের এ সমস্যা নিরসনে একটি নতুন খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ২০১৪ সালের ২৪ জুন ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। কিন্তু নির্ধারিত সময় তিন বছরের মধ্যে খালটি খনন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় সিটি করপোরেশন। অনুমোদনের পর দুই দফায় সংশোধন ও সময় বাড়িয়েও কাজ হয়নি।

দুই দফা প্রকল্প সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। ইতিমধ্যে সরকার সিটি করপোরেশনকে ৯১৪ কোটি টাকা দিয়েছে। এই টাকা ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে জমা দিয়েছে করপোরেশন।

তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের সময় প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। এরপর মেয়র ও প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন যথাক্রমে আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীন ও মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়াদের শেষ প্রান্তে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি তড়িঘড়ি করে প্রকল্পের খননকাজের উদ্বোধন করেছিলেন। তা ছিল একপ্রকার লোকদেখানো। কেননা, উদ্বোধনের পর কোনো কাজই হয়নি।

চট্টগ্রাম নগরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কথা কোনোভাবেই মানতে নারাজ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। তাঁর দাবি, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হচ্ছে। জেলা প্রশাসন জায়গা বুঝিয়ে দিলে খননকাজ শুরু হবে।

যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) মাসুদ কামাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নগরের বারইপাড়া এলাকার চাক্তাই খাল অংশ থেকে শুরু হওয়া এই খাল বলিরহাট হয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশবে। প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল খননের জন্য ২৫ দশমিক ১৬ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন খাল খনন প্রকল্প ছাড়াও আরও তিনটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সিটি করপোরেশনের নতুন খাল খনন প্রকল্পের কাজে কোনো অগ্রগতি না থাকলেও অন্য তিনটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।

বারবার কাটাছেঁড়া

বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেট, ষোলশহর, মুরাদপুর, শুলকবহর, বারইপাড়া, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, বাকলিয়া ও চাক্তাই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা নিরসনে ১৯৯৫ সালের প্রণীত ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনায় চাক্তাই খাল থেকে একটি নতুন খাল খননের সুপারিশ করা হয়েছিল। ১৯ বছর পর তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

২০১৪ সালের ২৪ জুন ৩২৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। সময় ছিল ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। ওই তিন বছরেও প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ২৫ দশমিক ২৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এরপর ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রকল্প সংশোধন করা হয়। এবার ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। সময় বর্ধিত করা হয় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। এবারও প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় সিটি করপোরেশন। গত জুনে প্রকল্পটি আবার সংশোধন করা হয়। এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

আখতার কবির চৌধুরী
সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতার কারণে বাড়তি এক হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, যা দিন শেষে নাগরিকদের পকেট থেকে যাবে।
আখতার কবির চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক, সুজন

সিটি করপোরেশন সাত বছরে একটি খাল খনন করতে ব্যর্থ হলেও একই সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) সমুদ্রপারে ১৫ কিলোমিটারের নতুন সড়ক ও দুটি উড়ালসড়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।

নতুন খাল খননের জন্য ২৫ একর জমি অধিগ্রহণে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২২৪ কোটি টাকা। এখন লাগবে ১ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। কেননা, ওই সময় ভূমি অধিগ্রহণের পর ক্ষতিপূরণ ছিল দেড় গুণ, কিন্তু পরে তা তিন গুণ করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য সব খাতেও দুই থেকে তিন গুণ ব্যয় বেড়েছে। এভাবে দফায় দফায় প্রকল্প ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নতুন খাল খনন চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছিল। কিন্তু অদক্ষতা, অযোগ্যতা, অসততা ও জবাবদিহির অভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতার কারণে বাড়তি এক হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, যা দিন শেষে নাগরিকদের পকেট থেকে যাবে।