কাঠামো নষ্টের পর ফেরত নেওয়া হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার অস্ট্রিচকে

অস্ট্রিচের কেবিনসহ ভেতরের সব অবকাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছে। এটিকে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে ঐতিহ্য রক্ষার বদলে নৌযানটিকে এখন ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করতে হবে।

প্যাডেল স্টিমার
ছবি: সংগৃহীত

ইজারা দেওয়ার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার পিএস অস্ট্রিচকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কয়েকটি ধাপ শেষ করেছে সরকারি সংস্থাটি। তবে সংস্কারের নামে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে শতবর্ষী এ নৌযানের ভেতরের অবকাঠামো।

অস্ট্রিচকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাকর্ড রিসোর্সেসের কাছে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ৫ বছরের জন্য ইজারা দিয়েছিল বিআইডব্লিউটিসি। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিমাসে ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল অ্যাকর্ডের। বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি ভাড়ার টাকা ঠিকমতো তো দেয়ইনি; উপরন্তু অস্ট্রিচের কেবিনসহ ভেতরের সব অবকাঠামো ভেঙে ফেলেছে। এটিকে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। ঐতিহ্য রক্ষার বদলে এটিকে এখন ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করতে হবে।

বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে কাঠামো পরিবর্তন করায় অ্যাকর্ডের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা হতে পারে। ভবিষ্যতে সংস্থার অন্য কোনো কাজে যাতে অংশ নিতে না পারে সে জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্তও করা হতে পারে।

বিআইডব্লিউটিসির তথ্যমতে, স্বল্প দূরত্বের নৌবিহার ও ভাসমান রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহার করতে পাঁচ বছরের জন্য অ্যাকর্ড রিসোর্সেসের কাছে পিএস অস্ট্রিচকে ভাড়া (চার্টার) দেওয়া হয় ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর। প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এর বিপরীতে নিরাপত্তা জামানত রাখা হয় ৭ লাখ ৯২ হাজার ২০০ টাকা এবং ব্যাংক গ্যারান্টি রাখা হয় ১ কোটি ৩৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩৩৮ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট সময় পর প্রতিমাসে ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল অ্যাকর্ডের। কিন্তু ওই সময় পার হওয়ার পর বারবার তাগাদা দিলেও ২৪ মাসে (মার্চ ২০২০ থেকে মার্চ ২০২২) নানা অজুহাতে কোনো ভাড়া পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। এতে এই ২৪ মাসে মোট ভাড়া বাকি পড়ে ৩১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।

অবকাঠামো ভেঙ্গে ফেলার পর অস্ট্রিচের ভেতরকার অবস্থা
ছবি: সংগৃহীত

ভাড়া আদায়ে বিআইডব্লিউটিসি চূড়ান্ত তাগাদাপত্র দিলে আলোচনার প্রস্তাব দেয় অ্যাকর্ড। আলোচনায় গত ১৫ মার্চের মধ্যে দুই কিস্তিতে ১০ লাখ টাকা পরিশোধের আশ্বাস দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে প্রথম কিস্তিতে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিজেদের প্রতিশ্রুতি না রেখে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২ লাখ টাকার একটি চেক জমা দেয় অ্যাকর্ড। এতে প্রতিষ্ঠানটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিআইডব্লিউটিসি। নোটিশে পিএস অস্ট্রিচকে কেন ফেরত নেওয়া হবে না—জানতে চাওয়া হয়। সে নোটিশের জবাব দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এরপরই অস্ট্রিচকে নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নিতে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শুরু করে বিআইডব্লিউটিসি।

প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ১৫ মার্চ নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসককে একটি চিঠি দেয় বিআইডব্লিউটিসি। নৌযানটি ফেরত নিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক পুলিশ সদস্যসহ একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপারকেও চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে অ্যাকর্ড রিসোর্সেসের পরিচালক (অপারেশন) লে. কমান্ডার (অব.) মাহবুবুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, পিএস অস্ট্রিচের মূল অবকাঠামোয় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। কেবিন মূল কাঠামোর অংশ নয়। শুধু পরিবর্ধন করা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিসির নৌবহরে থাকার সময়ে অস্ট্রিচের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি দাবি করে মাহবুবুর রশিদ বলেন, ‘আমরা শুনেছিলাম, এটি মাত্র ডকইয়ার্ড থেকে নামানো হয়েছে। কিন্তু এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। তখনই যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। ইজারা নেওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেই আমরা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলাম। অস্ট্রিচের বড় ধরনের মেরামতের প্রয়োজন ছিল; যা করাতে আমাদের ৩ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে। আমরা শুধু দুই বছরের ভাড়া মওকুফের কথা বলেছিলাম।’

আরও পড়ুন

বিআইডব্লিউটিসির তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত চলাচল করেছে অস্ট্রিচ। ওই সময় এটির তলা ফেটে যায়। এরপর মেরামতের জন্য এটিকে ডকইয়ার্ডে নেওয়া হয়। সেখান থেকেই ইজারা দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে অস্ট্রিচসহ আরও তিনটি প্যাডেল স্টিমারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ করার জন্য ইউনেসকোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ইউনেসকো তাতে সম্মত হয়ে স্টিমারগুলোর ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ ও এ-সম্পর্কিত একটি তথ্যচিত্র পাঠানোর কথা বলে। তবে মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত এর কিছুই করতে পারেনি।

অ্যাকর্ড রিসোর্সেসের কাছে ইজারা দেওয়ার পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় সংস্কারকালে অস্ট্রিচ
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

ইতিমধ্যে বিআইডব্লিউটিসি প্যাডেল স্টিমার পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহ্‌সুদ, পিএস লেপচা ও পিএস টার্নকে রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর অস্ট্রিচের একটি রেপ্লিকা জাতীয় জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ভাড়া দেওয়া হচ্ছে লেপচা ও টার্ন

অস্ট্রিচ ভাড়া দেওয়ার পর বিআইডব্লিউটিসির যাত্রীবাহী সার্ভিসে তিনটি রকেট স্টিমার—পিএস মাহ্‌সুদ, পিএস লেপচা ও পিএস টার্ন যুক্ত ছিল। লেপচা ও টার্নকেও পর্যটনের উদ্দেশ্যে পাঁচ বছরের জন্য ইজারা দিতে দরপত্র জমা নিয়েছে বিআইডব্লিউটিসি। লেপচা ১৯৩৮ সালে ও টার্ন ১৯৫০ সালে তৈরি করা হয়েছে। পিএস মাহ্‌সুদকেও সম্প্রতি যাত্রীপরিবহন সেবা থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটিকে বিআইডব্লিউটিসি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রমোদতরী হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে।

বিআইডব্লিউটিসির বাণিজ্য বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক নাসির মোহাম্মদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চল্লিশ বছর বা তদূর্ধ্ব পুরোনো নৌযানগুলো বিক্রি করতে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চেয়েছিল বিআইডব্লিউটিসি। ঐতিহ্য রক্ষায় প্যাডেল স্টিমারগুলো বিক্রি না করার পরামর্শ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

ইতিহাসের অংশ অস্ট্রিচ

একসময় ঢাকা-কলকাতা নৌপথে চলাচল করত প্যাডেল স্টিমার। এ ধরনের নৌযানের দুপাশে বিশালাকৃতির দুটি হুইল বা চাকা দিয়ে চালানোর জন্যই এগুলোর নাম হয় প্যাডেল স্টিমার। দ্রুতগতির জন্য যাত্রীদের কাছে এসব নৌযানের নাম হয় রকেট। ঐতিহ্যবাহী রকেট-স্টিমারে ভ্রমণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এসব নৌযানেরই একটি পিএস অস্ট্রিচ।

আরও পড়ুন

পিএস অস্ট্রিচ ১৯২৯ সালে কলকাতার গার্ডেন রিচ শিপইয়ার্ডে নির্মিত হয়। বেলজিয়াম সরকারের আর্থিক অনুদান ও কারিগরি সহায়তায় ১৯৮৩ সালে জাহাজটিকে স্টিম পদ্ধতি থেকে ডিজেলচালিত পদ্ধতিতে রূপান্তর করা হয়। ১৯৯৬ সালে জাহাজে রিডাকশন গিয়ার সংযোজন করা হয়। এমন স্টিমারের দুই পাশে পাখা থাকে, যা চাকার মতো ঘোরে এবং জাহাজকে পানিতে চলতে সাহায্য করে। নৌ–প্রকৌশলীদের মতে, এই পাখার কারণেই বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টিতেও এসব জাহাজ নিখুঁতভাবে ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে।

ঢাকা-খুলনাসহ অন্যান্য রুটে প্রায় শত বছরের যাত্রায় অস্ট্রিচ কখনো বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়নি। আশির দশক পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এর কদর ছিল ব্যাপক। বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের এতে চড়িয়ে ঘোরানো হতো। অস্ট্রিচ দৈর্ঘ্যে ২২৫ ফুট ও চওড়ায় ৩০ ফুট। এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০ নটিক্যাল মাইল। ৯০০ যাত্রী ও ১৫০ টন পণ্যসামগ্রী বহনে সক্ষম ছিল এটি।