মধ্যবিত্ত বিকাশের ভাষ্যকার

কামরুদ্দীন আহমদ

‘বাঙালনামা’র লেখক তপন রায়চৌধুরী ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ স্মারক বক্তৃতা দিতে ঢাকায় এসে খোঁজ করছিলেন কামরুদ্দীন আহমদের বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ এবং বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী বইয়ের। কবি-কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসের তথ্যসূত্রে পাওয়া যায় কামরুদ্দীন আহমদের বইয়ের নাম। হাসনাত আবদুল হাইয়ের নভেরা উপন্যাসের তৃতীয় অধ্যায়টি বর্ণিত হয়েছে কামরুদ্দীন আহমদের বয়ানে; রেঙ্গুনে নভেরা আহমদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ও সখ্যের সূত্রে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী কিংবা তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতেও তিনি এক বিশিষ্ট চরিত্র। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে ভাষা আন্দোলন, গণ–আজাদী লীগ, আওয়ামী লীগ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী—নানা প্রসঙ্গে বার দশেক এসেছে কামরুদ্দীন আহমদের নাম।

কামরুদ্দীন আহমদের জন্ম ১০৮ বছর আগের আজকের দিনে মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য ও আইনশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা সমাপন করে শিক্ষকতা, আইন পেশা, রাজনীতি, কূটনীতির বিচিত্র অঙ্গনে কেটেছে তাঁর সাত দশকের (১৯১২-৮২) বর্ণাঢ্য জীবন। পেশা যা-ই থাক, সব সময় পক্ষপাত ছিল গণমানুষের মুক্তির প্রতি। সেই তাড়না থেকেই ১৯৪৮ ও ৫২–এর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হওয়া, ১৯৪৭ সালে গণ–আজাদী লীগ গঠন আর ১৯৫৪-৫৭ কালপর্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন। ১৯৫৭-তে রাজনীতি ছেড়ে পরবর্তী পাঁচ বছর কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেছেন ভারত ও তৎকালীন বার্মায়। ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন থেকে এশিয়াটিক সোসাইটির মতো সংঘে তাঁর যুক্ততা প্রমাণ করে, তিনি যুগপৎ বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর ও মাঠের মানুষ। একাত্তরের অক্টোবরে তিনি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন, মুক্তি পান বিজয়ের অব্যবহিত পর। তাঁর প্রিয় পুত্র মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর সদস্য নিজামউদ্দিন আজাদ ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর কুমিল্লার বেতিয়ারায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম।

সমাজ–ইতিহাস গ্রন্থমালা: বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী, কামরুদ্দীন আহমদ, প্রথমা প্রকাশন

কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, A Socio-Political History of Bengal and Birth of Bangladesh, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড; এ মাসেই এটি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে), বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী এবং স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় শীর্ষক বইয়ের গুচ্ছে ধারণ করেছেন আত্মজীবন ও সমষ্টি-সময়। ব্যক্তিবিকাশের সমান্তরালে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ-গতিবিধি। তাঁর সমাজ-রাজনীতিগত সুগভীর পর্যবেক্ষণে বিশ্লেষিত হয়েছে ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় জাগ্রত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চারিত্র্য ও এর স্বাধীনতামুখী গন্তব্য।

২.

বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী (প্রথম সংস্করণ: ১৯৭৯, প্রথমা সংস্করণ: ২০১৮) কামরুদ্দীন আহমদের ‘মধ্যবিত্ত’ সিরিজের শেষ বই। সাতটি অধ্যায়ে ১৯৫৩-৬২ অর্থাৎ প্রায় এক দশকের রাজনৈতিক ও কূটনীতিক জীবনের স্মৃতিচারণা করেছেন, যেখানে একজন বাঙালি মধ্যবিত্তের রূপকে উঠে এসেছে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির রূপ-রূপান্তর, দ্বন্দ্ব ও বিকাশের বিশ্বস্ত চালচিত্র।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় শ্রমজীবীদের অধিকার সম্পর্কিত একটি দফা সংযোজনে তাঁর ভূমিকার কথা পড়ে অনুধাবনে আসে বিত্তহীনদের প্রতি এই মধ্যবিত্তের অঙ্গীকারের মাত্রা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে সফল বক্তৃতার পর যখন মন্তব্য করেন, ‘আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আমার বক্তৃতা অপরিপক্বতার একটি নিদর্শন বলে আমি আজ মনে করি’ তখন তাঁর আত্মবিশ্লেষণী সত্তার স্বরূপ ফুটে ওঠে। আবার একই অধিবেশনে ভারতীয় প্রতিনিধি কৃষ্ণমেনন সম্পর্কে যখন লেখেন ‘পাণ্ডিত্য ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে তাঁর অহমিকা ছিল না’ তখন বুঝতে পারি জ্ঞানসাধনার প্রতিই তাঁর সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা।

সমাজ–ইতিহাস গ্রন্থমালা: বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, কামরুদ্দীন আহমদ, প্রথমা প্রকাশন (প্রকাশিতব্য)

১৯৫৭-৫৮ সময়খণ্ডে কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনের বিবরণে তথ্যের বেশি তিনি পরিবেশন করেছেন ধরাবাঁধা কর্মসূত্রে পাওয়া বিস্তৃত বিশ্বের সংবাদ ও সংবেদ। কলকাতায় অসুস্থ কবি নজরুলকে দেখে আর প্রমীলা নজরুলের আর্তিভরা চিঠি পেয়ে তিনি কাতর হয়েছেন। কলকাতা থেকে দিল্লি যাত্রাপথে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে একই বিমানের যাত্রী হয়ে যখন আবিষ্কার করেন ভারতের তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী যাচ্ছেন দ্বিতীয় শ্রেণির কামরায়, তখন বলতে ভোলেন না, ‘এমন লোকই দেশে একটা রেল অ্যাকসিডেন্ট হলে মন্ত্রিত্ব পদে ইস্তফা দিতে পারেন।’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি অবলম্বনে আর জে কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য তৃপ্তি মিত্রকে ভারত থেকে পাকিস্তান যাওয়ার ভিসা দেওয়ার স্মৃতি রোমন্থনের পাশাপাশি লেখক-পরিবার নিয়ে তাঁর ভাবনাও দোলা দেয় আমাদের মনে, ‘ছবিটি ভালোই হয়েছিল। অবশ্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবা স্ত্রীকে কিছু পয়সা দেওয়া উচিত ছিল বলে আমার ধারণা।’

মুনীর চৌধুরী, পদ্মজা নাইডু কিংবা আগা খান—জীবনবাঁকে যাঁর সঙ্গেই দেখা হয়েছে, তাঁর স্মরণীয় ছবি এঁকেছেন তিনি স্মৃতির তুলিশব্দে; তাই পাঠকের পটে অনায়াসে ঘটে তাঁদের বরণ।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে দাপ্তরিক দেখা হওয়ার বর্ণনায় কামরুদ্দীন জানান, ‘তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে তাঁর আত্মজীবনী লেখা দেশের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। তাঁর মতো দেশসেবক নেতা যদি স্বীয় অভিজ্ঞতা লিখে না যান, তবে ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিকট ছোট হয়ে যাবেন।’

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এমন হিতকামী ভাবনা থেকেই হয়তো কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর অনুপম জীবনকথা রেখে গেছেন কয়েক খণ্ডের বইয়ে; যেখানে কলকাতার পরিচিত পরিপার্শ্ব থেকে তৎকালীন বার্মার অচেনা আবহও সমান আলোচিত। কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার থেকে ১৯৫৮ সালের শেষার্ধে বার্মায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে উন্নীত হওয়ার পদগৌরব তাঁকে যতটা না আহ্লাদিত করেছিল, তার বেশি আপ্লুত করেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সময়কার বার্মিজ গল্প; সুয়েডেগন প্যাগোডা দেখার সঙ্গে তাই অনায়াসে মিলিয়ে পড়তে পারেন রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের কবিতা। বার্মায় সেনাশাসন কায়েম আর পাকিস্তানে মার্শাল ল জারির প্রেক্ষিতে তাঁর অসাধারণ অভিমত, ‘রাজনীতি করার জন্য যারা মাঠে নামে, তারা ফুটবল খেলার “ফাউল” করে। মাঝে মাঝে রেফারি কাউকে মাঠ থেকে বের করে দেয়। কাদা-ছোড়াছুড়ি হয়। তার জন্য রাজনীতি করা বন্ধ করে দেওয়া হবে, এটা দেশের পক্ষে ভালো হতে পারে না।’

আরাকান-আকিয়াব-মান্দালয়ের পথ থেকে বর্মি-জনতার অন্তরমহলে যাতায়াতের ইতিবৃত্ত আখ্যানের মতো ভাস্বর হয়েছে তাঁর স্মৃতিমঞ্জরিতে। বাংলা না-জানা বর্মি কূটনীতিক ও অনের ব্যক্তিগত পাঠাগারে মনস্বী বাঙালি লেখক কাজী আবদুল ওদুদের ‘প্রবন্ধ সংকলন’ আবিষ্কার যেমন তাঁকে বিস্মিত করেছে, তেমনি বার্মিজদের হাসির গল্প বলতে গিয়ে নিজ পেশা সম্পর্কে অযথা গাম্ভীর্যে না ভুগে বলেন, ‘বার্মিজদের সবচেয়ে বড় গুণ তারা হাসতে জানে। গরমের দিনে কূটনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কালো কোট গায়ে দিলে তাকে নিয়ে ছেলেমেয়েরা তো বটেই, বৃদ্ধরাও হেসে হেসে খুন হতো।’

কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর এ বই শেষ করেছেন কূটনীতিক-জীবনের অবসান, ঢাকা ও আইন পেশায় প্রত্যাবর্তন, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ, পূর্ব বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতে বিপুল পরিবর্তনের ঢেউ, রাজনীতির সমুদ্রে ঝড় আর স্বাধীন স্বদেশের অনিবার্য আভাসে।

ব্যক্তির বয়ানে এভাবে এই বিরল আত্মকাহিনি ধারণ করেছে আমাদের প্রাণের কথন।