কামরুলের সহজিয়ায় বাংলার রূপ

শিল্পী কামরুল হাসানের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে ‘সহজিয়া’ শিরোনামে প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে বক্তব্য দেন শিল্পী রফিকুন নবী। মঞ্চে বাঁ থেকে ওয়াকিলুর রহমান, সৈয়দ আবুল বার্‌ক আল্‌ভী, সৈয়দ আজিজুল হক ও নাসিমুন আরা হক। গতকাল মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের কলাকেন্দ্রেছবি: খালেদ সরকার

বাংলার নিসর্গের রূপ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপাদান, মানব-মানবীর দেহাবয়ব থেকে জীবনযাত্রার বহুবিধ অনুষঙ্গ অপূর্ব লীলায়িত ছন্দময় রেখা আর রঙের প্রলেপে চোখজুড়ানো রূপে ফুটিয়ে তুলতেন তিনি। বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলা যাঁদের হাতে যাত্রা শুরু, তাঁদের অন্যতম ছিলেন। কিন্তু নিজেকে ‘পটুয়া’ বলে পরিচয় দিতেই পছন্দ করতেন—তিনি কামরুল হাসান। আগামী ২ ডিসেম্বর তাঁর জন্মশতবর্ষ। দেশের এই শিল্পগুরুর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন করতেই তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে এক বিশেষ প্রদর্শনী শুরু হলো।

‘সহজিয়া’ নামের এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে শিল্পীদের উদ্যোগে পরিচালিত শিল্পালয় ‘কলাকেন্দ্র’। মোহাম্মদপুরের ১/১১ ইকবাল রোডের বাড়ির কলাকেন্দ্রে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী। আলোচক ছিলেন শিল্পসমালোচক অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও নাসিমুন আরা হক। সঞ্চালনা করেন কলাকেন্দ্রের পরিচালক শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। প্রদর্শনী চলবে আগামী ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।

সহজিয়ায় তৈলচিত্র, মিশ্র মাধ্যম, পোস্টার রং, জলরং, প্যাস্টেল, কাঠখোদাই, কালি–কলমের রেখাচিত্রসহ বিভিন্ন মাধ্যমের ১১০টি শিল্পকর্ম রয়েছে। এগুলো সবই ব্যক্তিগত শিল্পসংগ্রাহকদের। প্রদর্শনীর শুরুতেই সঞ্চালক জানালেন, কলাকেন্দ্র তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেই এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। যাঁরা প্রদর্শনীর জন্য তাঁদের সংগ্রহের ছবি দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি ধন্যবাদ জানান।

প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে রফিকুন নবী এ প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য শিল্পীসমাজের পক্ষ থেকে কলাকেন্দ্রকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, কামরুল হাসানের জন্মশতবর্ষের আয়োজন হয়তো ভবিষ্যতে হতে পারে। তবে এ প্রদর্শনী জন্মশতবর্ষের আয়োজনে মাইলফলক হয়ে থাকল। কামরুল হাসানের কাজগুলো সংগ্রাহকেরা সাধারণ দর্শকদের দেখার একটি দুর্লভ সুযোগ করে দিলেন। এসব কাজ থেকে শিল্পশিক্ষার্থী এবং নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের বহু কিছু শেখার আছে। তিনি নিজে এখনো কামরুল হাসানের শিল্পকর্ম থেকে অনুপ্রেরণা ও শিক্ষণীয় বিষয় খুঁজে পান বলে জানান।

রফিকুন নবী বলেন, কামরুল হাসান অনবরত কাজ করতেন। তাঁর আঁকা, রঙের প্রয়োগ, ঐতিহ্যলগ্নতা এবং স্বকীয়তা মিলে তিনি অনন্য। ইয়াহিয়ার যে মুখচ্ছবি তিনি এঁকেছিলেন, তা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, শিল্পকলা চর্চার পাশাপাশি সেই সময় বিরুদ্ধ সামাজিক পরিবেশে চারুকলার চর্চাকে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করা, শিল্পীদের সামাজিক মর্যাদার আসনে নিয়ে যাওয়ার কাজও তাঁকে করতে হয়েছে।

শিল্পী কামরুল হাসান
ছবি: নাসির আলী মামুন

সৈয়দ আজিজুল হক তাঁর বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় কামরুল হাসানের চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করে বলেন, তাঁর শিল্পকলা তিনটি প্রধান ভাগে ফেলা যায়। লোক–ঐতিহ্যনির্ভর কাজ, রাজনৈতিক চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির কাজ ও কার্টুন এবং মানব, বিশেষ করে নারীর অবয়বনির্ভর কাজ। তিনি নিজেকে পটুয়া বলতেন গভীর ঐতিহ্য অনুরাগ থেকে। পটুয়াদের রেখা ও রঙের প্রয়োগরীতির সঙ্গে ইউরোপীয় আধুনিক আঙ্গিকের সুসমন্বয় করে নিজের একটি প্রকাশভঙ্গি তিনি সৃজন করতে পেরেছিলেন। সে কারণেই তিনি অনন্য।

মতিউর রহমান তুলে আনেন কামরুল হাসানের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও রাজনৈতিক চেতনার দিকটি। তিনি বলেন, সেই ভাষা আন্দোলন থেকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত বাংলাদেশের এমন কোনো আন্দোলন নেই, যেখানে কামরুল হাসান কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। চিত্রকলাকে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন।

সম্প্রতি প্রয়াত কবি, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাতের স্ত্রী নাসিমুন আরা হক বলেন, ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের ছবির এমন প্রদর্শনীর আয়োজন নিয়মিত হলে বহু বিখ্যাত শিল্পীর অনেক দুর্লভ কাজ সাধারণ দর্শকেরা দেখার সুযোগ পাবেন।

কামরুল হাসানের জন্ম ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস থেকে চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে অন্যতম সহযোগী হিসেবে ঢাকায় গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠা করেন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মূলত তাঁর উদ্যোগই বিসিকের নকশাকেন্দ্র গঠিত হয়, তিনি ১৯৬০ সালে এখানে প্রধান নকশাবিদ হিসেবে যোগ দেন। ঢাকায় পয়লা বৈশাখে বৈশাখী মেলারও উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্রবাসী সরকারের আর্ট ও ডিজাইন বিভাগের প্রধান ছিলেন। স্বাধীনতা পুরস্কারসহ দেশ–বিদেশ বহু সম্মাননা পেয়েছেন। এই বহুপ্রজ শিল্পীর আঁকা আকস্মিকভাবেই চিরকালের জন্য থেমে যায় ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় কবিতা পরিষদের অধিবেশনের সভাপতিত্ব করার সময়। তখন তিনি আঁকছিলেন ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’। দেশের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসাই দেশবাসীর মনে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।