কারও বিরুদ্ধে হত্যা, কারও বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ

১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বালক কেন্দ্রে অনুমোদিত আসনসংখ্যা ৩০০। তবে শিশু থাকে দ্বিগুণের বেশি
ফাইল ছবি

‘আমরা একসঙ্গে পুকুরে গোসল করতে যাই। ও ডুবে মারা যায়।’ ঘাড়ে হত্যা মামলার ভার নিয়ে এ মন্তব্য করে ১৭ বছর বয়সী কিশোরটি। জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার এক কৃষকের ছেলে। মারা যাওয়া শিশুটির পরিবার কিশোরের বিরুদ্ধে পানিতে ডুবিয়ে হত্যার অভিযোগে মামলা করে। মামলাটি বিচারাধীন। সম্প্রতি টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালক) প্রশাসনিক ভবনে কথা হয় কিশোরের সঙ্গে। ঠিক তিন বছর আগের ওই ঘটনাকে দুর্ঘটনা দাবি করে কিশোরটি জানায়, ওই সময় সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। দুই ভাইবোনের মধ্যে সে বড়।

আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে—এমন আট কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে টঙ্গী ও কোনাবাড়ীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে কথা হয়েছে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের।

আটজনের মধ্যে একজন সচ্ছল, তিনজন মধ্যবিত্ত এবং চারজন দরিদ্র পরিবারের। তাদের মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে হত্যা, একজনের বিরুদ্ধে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন, একজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, একজনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, এক রোহিঙ্গা কিশোরীর বিরুদ্ধে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির থেকে আইন লঙ্ঘন করে বেরিয়ে যাওয়ার মামলা রয়েছে। আর একজন ভুক্তভোগী। বাল্যবিবাহের দায়ে বাবার করা মামলায় আড়াই বছর ধরে কোনাবাড়ীতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালিকা) রয়েছে সে। আলাপচারিতায় তারা প্রত্যেকে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছে।

গাজীপুরের টঙ্গী ও কোনাবাড়ী এবং যশোরে তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রয়েছে হাজারের মতো কিশোর-কিশোরী। কেন্দ্রগুলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয়। নিবাসীদের বয়স ১০ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। অনুমোদিত আসন ৬০০।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, কিশোর বয়স একটা অন্য রকম সময়। শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করে তারা নিজের মতো করে আত্মপরিচয় চায়। কোনো কিছুর পরিণতি বিবেচনা করে না। ভালো-খারাপের ধারণা ততটা গ্রহণ করতে চায় না। পরিবার থেকে এই আত্মপরিচয়ের জায়গা যদি না দেওয়া হয়, তার ভাবনা যদি গুরুত্ব না পায়, তখন অনেক কিছুই তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

কিশোরের ব্যাগে ইয়াবা পায় পুলিশ

বালক কেন্দ্রের সবচেয়ে পুরোনো নিবাসী টেকনাফের কিশোর (১৭)। চার বছর ধরে রয়েছে সে। ওই কিশোর জানায়, আত্মীয়ের পোশাক তৈরির ছোট কারখানায় চার হাজার টাকা বেতনে কাজ করত সে। ২০১৬ সালে কাপড় কেনার জন্য সে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। চট্টগ্রামে তার ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ইয়াবা পায়। ব্যাগে কে ইয়াবা ঢুকিয়েছে, তা সে জানে না।

সিলেটের কিশোরটির (১৬) বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে প্রতিবেশীর আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ওই কিশোরের বাবা কুয়েতপ্রবাসী। কিশোরটির ভাষ্য, ধার টাকা পরিশোধ নিয়ে বিরোধ থেকে তাকে ধর্ষণ মামলার আসামি করা হয়েছে।
একইভাবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছে রাজধানীর দক্ষিণের একটি এলাকার কলেজছাত্র (১৭)। তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফির মামলা করা হয়েছে।

১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বালক কেন্দ্রে অনুমোদিত আসনসংখ্যা ৩০০। তবে শিশু থাকে দ্বিগুণের বেশি। টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র জানিয়েছে, সেখানে প্রতিদিনই কিশোরের সংখ্যা ওঠানামা করে। অক্টোবর মাসজুড়ে প্রায় ৭০০ শিশু-কিশোরের মধ্যে হত্যা মামলার আসামি সবচেয়ে বেশি, ১৯৬ জন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার আসামি ১৭৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৯৪ জন, চুরি ৭৮, মারামারি ৪৪, ছিনতাই ২১ জন এবং বাকিরা বিভিন্ন মামলার।

টঙ্গী বালক কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ এহিয়াতুজ্জামান বলেন, নিবাসীদের মধ্যে সামাজিকভাবে সহযোগিতা-সমর্থন পায় না, দরিদ্র, গৃহহীন, ভূমিহীন পরিবারের ছেলেদের সংখ্যাই বেশি। সাজা পাওয়া শিশুর বয়স ১৮ পেরিয়ে গেলে তাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এ কেন্দ্রের সোশ্যাল কেসওয়ার্কার ফারহানা সরকার বলেন, ‘আমরা কাউন্সেলিং করি যেন তারা আর কখনো আইনি সংঘাতে না জড়ায়।’

কিশোর বয়স একটা অন্য রকম সময়। শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করে তারা নিজের মতো করে আত্মপরিচয় চায়। কোনো কিছুর পরিণতি বিবেচনা করে না। ভালো-খারাপের ধারণা ততটা গ্রহণ করতে চায় না। পরিবার থেকে এই আত্মপরিচয়ের জায়গা যদি না দেওয়া হয়, তার ভাবনা যদি গুরুত্ব না পায়, তখন অনেক কিছুই তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
মেখলা সরকার, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

কিশোরীর বিরুদ্ধে হত্যা-প্রতারণার মামলা

প্রথম আলোর সঙ্গে মেয়েটির যেদিন কথা হয়, সেদিনই ছিল শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকার তাঁর শেষ দিন। ১৮ বছর বয়স হয়ে যাওয়ায় তাঁকে কেন্দ্র থেকে কাশিমপুরে কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছিল। কারাগার থেকে দুজন নারী পুলিশ সদস্য এসেছেন তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এর ফাঁকেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। হত্যা ও প্রতারণা মামলার আসামি হিসেবে দুই বছরের বেশি সময় তিনি টঙ্গীর কোনাবাড়ীতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালিকা) ছিলেন। কথা বলার সময় বারবার চোখ পানিতে ভরে উঠছিল সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ মেয়েটির।

মামলাটি সম্পর্কে জানা যায়, একটি চক্র মডেল ও অভিনেত্রীদের নাম করে মেয়েদের সঙ্গে অশ্লীল ছবি তুলে প্রতারণা করত। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) একজন পরিদর্শককে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ আগুনে পুড়িয়ে দেয় ওই চক্রের লোকজন। মারামারির সময় মেয়েটি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল।

টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র জানিয়েছে, সেখানে প্রতিদিনই কিশোরের সংখ্যা ওঠানামা করে। অক্টোবর মাসজুড়ে প্রায় ৭০০ শিশু-কিশোরের মধ্যে হত্যা মামলার আসামি সবচেয়ে বেশি, ১৯৬ জন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার আসামি ১৭৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা সবচেয়ে বেশি।

আরেক কিশোরী (১৬) বাবা হত্যা মামলার ছয় আসামির একজন। ওই মামলায় গাজীপুর জেলা কারাগারে আটক রয়েছেন মেয়েটির মা, প্রেমিক ও তাঁর তিন বন্ধু। বাবা সম্পর্কে মেয়েটির ভাষ্য, ‘বাবা অনেক অত্যাচারী ছিল।’ তবে সে বা তার মা হত্যাকাণ্ড ঘটায়নি।

রোহিঙ্গা কিশোরী (১৬) জানায়, গত বছরের নভেম্বরে এক নারী তাকে মাদকজাতীয় কিছু সেবন করিয়ে শিবির থেকে বের করে আনে। পরে ঢাকার একটি রাস্তায় তাকে বেহুঁশ অবস্থায় উদ্ধার করে বিমানবন্দর থানার পুলিশ। সে নয় ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়।

বাল্যবিবাহ করা হিন্দু কিশোরী (১৭) জানায়, মুসলিম ছেলে বিয়ে করায় বাবা রেগে গিয়ে মামলা করেছেন। তবে এখন দুই পক্ষ বিয়েটা মেনে নিচ্ছে।

২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত বালিকা কেন্দ্রে অনুমোদিত আসনসংখ্যা ১৫০। অক্টোবরে সেখানে রয়েছে ৭৫ জন। এর মধ্যে ৪৯ জনই ভুক্তভোগী। বিচারাধীন হত্যা মামলার আসামি আটজন। বাকিরা বিভিন্ন মামলার আসামি।

বালিকা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক খোরশেদা আকতার রোজী বলেন, অভিভাবকদের অসম্মতিতে বিয়ে করে বা পাচার-ধর্ষণের শিকার হয় বা ধর্ষণের কারণে সন্তান জন্ম দেওয়াসহ নানা নির্যাতনের শিকার অভিভাবকহীন মেয়েরাই এ কেন্দ্রে বেশি থাকে।
কেন্দ্রের সোশ্যাল কেসওয়ার্কার তাসনিম ফেরদৌস বলেন, মেয়েদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। সেলাই, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মেয়েদের মানসিকশক্তি জোগানো হয়।

বেশির ভাগই পরিবারের ভালোবাসাবঞ্চিত

অপরাধে সম্পৃক্ত কিশোর-কিশোরীর ‘বিচ্যুত আচরণ’ এবং এর পেছনে সামাজিক বন্ধনের ভূমিকা কতখানি, তা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমানের অধীনে চার বছরের পিএইচডি করছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের (সমাজবিজ্ঞান) সহকারী অধ্যাপক সুহেলী সায়লা আহমেদ। গত বছরের মার্চ থেকে আগস্ট এবং এ বছরের অক্টোবরে ১০ দফায় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ২৮ কিশোর-কিশোরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন তিনি।

এই শিক্ষক বলেন, শিশুদের প্রত্যেকে ছিল দরিদ্র ঘরের। অনেকের বাবা তাদের ফেলে চলে গেছেন, অনেকের মা অন্যত্র বিয়ে করেছেন। তারা বড় হয়েছে নানাবাড়িতে। কারও মা–বাবা থাকলেও তাদের প্রতি স্নেহপ্রবণ নয়। পারিবারিক বন্ধন নেই বললেই চলে। আর এই কিশোর-কিশোরীরা একই রকম পারিবারিক–সংস্কৃতির বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করে। বন্ধুদের মাধ্যমে মাদকের চক্রে ঢুকে পড়ে।

এই শিক্ষক বলেন, ‘তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা দরকার, তা তারা পায়নি। সামাজিক বন্ধনের চারটি উপাদান—সংযুক্তি, প্রতিশ্রুতি, সম্পৃক্ততা ও বিশ্বাস তাদের মধ্যে অনুপস্থিত।’

করোনাকালে ৮৬৭ জনের জামিন

করোনাকালে রাষ্ট্রপতি একটি অধ্যাদেশ জারি করে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু করার নির্দেশ দেন। এর কিছুদিনের মধ্যে শিশুদের জন্যও প্রথম ভার্চ্যুয়াল আদালত শুরু হয়।
ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা কর্মকর্তা শাবনাজ জাহেরীন বলেন, গত ১২ মে থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ভার্চ্যুয়াল আদালতের মাধ্যমে ৮৬৭ শিশুকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে দেখা যাচ্ছে, এতসংখ্যক শিশুর জামিন হলেও কেন্দ্রগুলোয় শিশুর সংখ্যা কমছে না। ধারণা করা হচ্ছে, করোনাকালে দরিদ্রতার সুযোগে শিশুদের দিয়ে বেশি করে অপরাধ করাচ্ছে অপরাধী চক্র। শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারে শিথিলতার সুযোগ নিচ্ছে ওই চক্র।

ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচি প্রধান শাহরিয়ার সাদাত বলেন, করোনাকালে জামিন পাওয়া শিশুরা চুরি ও মাদকের মামলার আসামি ছিল। তিনি জানান, গত পাঁচ বছরে ব্র্যাক টঙ্গী ও কোনাবাড়ীর প্রায় ৩০০ শিশুকে আইনি সহায়তা দিয়েছে।

অনুন্নত সংশোধনপ্রক্রিয়া, সীমিত বাজেট, প্রশাসনিক দুর্বলতা, অপর্যাপ্ত জনবল, যথাযথ পুনর্বাসন কার্যক্রমের অভাবসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে একজন কিশোরকে সংশোধনের মাধ্যমে সমাজে পুনর্বাসন করা সম্ভব কি না, তা জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু প্রথম আলোকে বলেন, যেসব ঘাটতি রয়েছে, তা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। সীমিত জায়গায় অনেক ছেলেকে থাকতে হচ্ছে। এ কারণে প্রতিটি বিভাগে একটি করে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।