কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন দেশে ফেরার দিনটির স্মৃতিতে ১০ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে প্রথম আলো একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল। সেটি ছিল তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে প্রথম আলোর এক বছরের পরিক্রমার সূচনা। সে বর্ষচক্র আজ পূর্ণ হলো। আজ রইল মুক্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লন্ডন থেকে তাঁর ফিরে আসার অন্তরঙ্গ স্মৃতি।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আলোকচিত্র অবলম্বনে সচিত্রকরণ করেছেন আরাফাত করিম

‘রেজাই করিম, শেখ মুজিব বলছি।’ গভীর, অতিপরিচিত ও অতি–আকাঙ্ক্ষিত স্বর ভেসে এল টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে। সময় ছিল সকাল প্রায় ৫টা, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি এবং স্থান লন্ডন।

আমি বাক্যহীন, শিহরিত। বাংলাদেশের জনগণের হারিয়ে যাওয়া নেতা যাঁকে সুদীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর মুখোমুখি থাকতে হয়েছে, যাঁর মুক্তির জন্য আমরা বিশ্বব্যাপী সর্বক্ষণ সর্বপ্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছি, তিনি আজ মুক্ত; স্বাধীন মাটিতে সশরীর এসে পৌঁছেছেন লন্ডনে।

‘আপনি কেমন আছেন, আপনার শরীর কেমন?’

‘আমি আছি কোনোরকম। তোমরা সকলে কেমন আছ?’ ক্লান্তস্বরে এল জবাব। একটু স্বস্তির রেশ ছিল বলে মনে হয়।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমার বাসার টেলিফোন নম্বর দেওয়ায় ডক্টর কামাল হোসেন আমাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে মিলিয়ে দিলেন। ডক্টর কামাল হোসেনও সপরিবার একই বিমানে পাকিস্তান থেকে এলেন। লন্ডনের বেসরকারি বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রধান মরহুম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে আমিই তখন দূতাবাসের অস্থায়ী প্রধান হিসেবে কার্যরত ছিলাম।

বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে আমি এমন বেগে গাড়ি চালিয়েছি যে জীবনে এত বেগে কখনো গাড়ি চালাইনি। ঝড়ের বেগে কামরায় ঢুকেই বঙ্গবন্ধুকে দেখে থমকে দাঁড়ালাম। বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে ছিলেন। সফরে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, যথারীতি তাঁর হাতে ছিল প্রিয় পাইপ। হাসিমুখে দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন।

‘সত্যিই আমরা স্বাধীন হয়েছি?’ অল্পক্ষণের মধ্যেই সংযত হয়ে প্রশ্ন করলেন বঙ্গবন্ধু। ‘জি হ্যাঁ, সত্যিই, সত্যিই।’ আমি তাঁকে জোরালোভাবে আশ্বস্ত করলাম।

আমরা কথা বলছিলাম—বেশ কিছু কথা হলো—বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনের, সহকর্মীদের, দেশের পরিস্থিতির ওপর, যদিও সংক্ষেপে। কারণ, সত্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশীয় বিভাগের ইয়ান সাদারল্যান্ড কামরায় ঢুকলেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানালেন।

প্রথম বিবেচ্য বিষয়টি ছিল, বঙ্গবন্ধু কোথায় থাকবেন। তিনি বললেন, কেন, দুই বছর আগে যেখানে ছিলাম, সেই হোটেলটা এমন কিছু খারাপ ছিল না। আমার মনে হলো, ওটা রাসেল স্কয়ারের প্রেসিডেন্ট হোটেল, যেখানে সাধারণত ছাত্রছাত্রীরা থাকে। আমি বললাম, ওটা ঠিক হবে না এবং সাদারল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনার পর বললাম, যে হোটেলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী থেকেছেন, সেই ক্ল্যারিজেস হোটেলে আপনি থাকবেন।

‘সে তো অনেক খরচ, এত পয়সা পাবি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। জীবনের প্রথম ও শেষবারের মতো আমি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশ বা হুমকি অমান্য করলাম। সাদারল্যান্ড টেলিফোনে হোটেল বুকিং সেরে ফেললেন।

ক্ল্যারিজেসে পৌঁছানোর পর অগণিত দর্শনার্থী, গণমাধ্যম প্রতিনিধি ও হাজারো বাঙালি হোটেলে ভিড় জমালেন বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য। দূতাবাসের সব কষ্টসহিষ্ণু ও নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মীর সহযোগিতায় আমরা সর্বপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি করতে সক্ষম হলাম। আমি সর্বপ্রথম টেলিফোনে বেগম মুজিব ও পরিবারের অন্যদের ও তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারপরই করলাম শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে। যেসব গণ্যমান্য ব্যক্তি হোটেলে দেখা করতে এলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হ্যারন্ড উইলসন, কমনওয়েলথের মহাসচিব আরনল্ড স্মিথ, সাবেক মন্ত্রী পিটার শোরসহ বহু সাংসদ ও অন্যরা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাঁর সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করতে চেকার্সে গিয়েছিলেন। তিনি সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে লন্ডনে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

বিশ্বের সর্বপ্রান্ত থেকে সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের প্রতিনিধিরা জড়ো হলেন ক্ল্যারিজেসে। সবাই চান একান্ত সাক্ষাৎকারের অনুমতি। কয়েকজনকে দিলে অন্যরা অসন্তুষ্ট হবেন। তাই ঠিক হলো, একটা সংবাদ সম্মেলন করা হবে। খুব তাড়াতাড়ি করে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও প্রতিষ্ঠাতার প্রথম সরকারি বক্তৃতার খসড়া তৈরি করলাম। ডক্টর কামাল হোসেন সেটাকে আরও সুন্দর করলেন। সাংবাদিকদের সম্ভাব্য প্রশ্নসংবলিত একটা তালিকাও বঙ্গবন্ধুকে পড়ে শোনালাম। শুনলেন, হেসে বললেন, জবাবগুলো তোমার বলা লাগবে না। ইতিমধ্যেই জেনে গেছি। সবাই অধীর আগ্রহে নতুন জাতির নতুন নেতার বক্তব্য শুনলেন।

ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা সরকারি বিমানের ব্যবস্থা করল। সাইপ্রাসে তেল নিয়ে এটা দিল্লি হয়ে ঢাকায় যাবে। বঙ্গবন্ধুর ফিরে যাওয়ার দিনক্ষণ গোপন রাখা হয়েছিল, নিরাপত্তার প্রয়োজনে।

প্রায় সকাল পাঁচটার সময় অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযাত্রীদের হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে নিয়ে গেলাম বিমানবন্দরে। ব্রিটিশ সরকারের কমেট বিমানটি তাঁদের সবাইকে নিয়ে যখন উড়ল, তখন বাজে প্রায় সকাল সাতটা।

এস এম রেজাউল করিমের অভিজ্ঞতার আলোয় (পার্ল পাবলিকেশন্স, ২০০১) থেকে সংক্ষেপিত

এস এম রেজাউল করিম: যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ মিশনের তৎকালীন অস্থায়ী প্রধান