‘কারাগারে নিয়োগ-পদায়নে জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা’

মুহম্মদ লিয়াকত আলী খান।
সংগৃহীত

১৯৭৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কারাগারে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন লিয়াকত আলী খান। সর্বশেষ ২০০০-২০০১ সালে কারা অধিদপ্তরের কারা মহাপরিদর্শকের (আইজি প্রিজন) দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কাশিমপুর কারাগারের অনিয়মসহ কারাগারের বিভিন্ন অপরাধ ও দুর্নীতি কেন হচ্ছে, তার কারণ ও এসব সমস্যা সমাধানে কারা প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিতে পারে, সে বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন মুহম্মদ লিয়াকত আলী খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কারাগারের ভেতর নিয়মবহির্ভূতভাবে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে, বিয়ে হচ্ছে, ব্যবসায়িক বৈঠক হচ্ছে, আসামির সঙ্গে আত্মীয়স্বজন এসে হাসপাতালে রাত্রিযাপন করছেন। এত অনিয়ম কেন হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

লিয়াকত আলী খান: এটা এক দিনে হয়নি। অনেক দিন ধরেই হয়ে আসছে। আমার মনে হয় এসব অপরাধ বেড়ে যাওয়ার হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে কারাবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ না করা। অন্যদিকে যাঁরা অপরাধ করছেন, তাঁদের চিহ্নিত করা হলেও শাস্তি হচ্ছে হাতেগোনা কিছু মানুষের। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের সাহস বাড়ছে। এর জন্য ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের দায় রয়েছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ১৯৭৩, ২০০১ বা ২০২১ সালের কারা প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় কী অমিল পাচ্ছেন?

লিয়াকত আলী খান: কোনো মিলই নেই। কারা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনার ধরন পাল্টে গেছে। যখন আমরা ছিলাম, তখন বিভাগীয় পর্যায়ে অত্যন্ত যোগ্য লোকের পদায়ন করতাম। এখন তো ‌‌জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা চলছে। নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, এমনকি আইজি প্রিজনসকে নিয়োগবিধি মেনে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে নিরাশা তৈরি হচ্ছে। অব্যবস্থাপনা বাড়ছে। যার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তিনি যদি এসে কারাগারের দায়িত্ব নেন, তাহলে কীভাবে কর্মকর্তাদের ‌নিয়ন্ত্রণ করবেন? এসব অপরাধ দেখে ২০ বছর আগে নিজেও যে আইজি প্রিজন ছিলাম, তা বলতে খুব লজ্জা হচ্ছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কারাগারের কর্মকর্তাদের বেতন–ভাতা কি কম, যে জন্য এমন অপরাধ বাড়ছে?

লিয়াকত আলী খান: কারাগারের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করেছে সরকার। সুযোগ-সুবিধা অনেক বেড়েছে। আপনি বলতে পারেন লোভ বেড়ে গেছে, চাহিদা বেড়ে গেছে। আবার ক্ষমতার অপপ্রয়োগও হচ্ছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কোন ধরনের পদক্ষেপ কারাগারে দুর্নীতি বাড়াতে সহায়ক হয় বলে মনে করেন?

লিয়াকত আলী খান: আসলে কারাগারের গেট থেকে শুরু হয় অনিয়ম। আর ক্যানটিন থেকেই শুরু হয় দুর্নীতি। এটা একটা বিরাট বাণিজ্য। এই ক্যানটিন–ব্যবস্থা করা উচিত হয়নি। এ ছাড়া কারাগারের কর্মচারীরা ফোর্স নন, তাঁরা গার্ড। এই মনোভাবেও পরিবর্তন এসেছে। নিজেদের তাঁরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের মতো মনে করেন। এ ছাড়া কারাগারের ভেতর জেলারদের নিয়মিত পরিদর্শন করা উচিত। বেশ কিছু দিন আগে দেখলাম কারাগারের ভেতর তৈরি করা মই বের হয়ে গেছে। জেলার নিয়মিত পরিদর্শন করলে তো তাঁর এসব চোখে পড়ার কথা। জেল সুপারও এসব তদারকি করেন না। যেখানে সাক্ষাৎকার বন্ধ, সেখানে যেভাবে সাক্ষাৎ করল, তা ন্যক্কারজনক। এই ঘটনা ৬ তারিখে ঘটল, অথচ এখন এসে প্রত্যাহার করল। কেন প্রত্যাহার, তাঁদের তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করা উচিত ছিল। এসব অপরাধের জন্য বিভাগীয় ও আইনি দুই ব্যবস্থাই নেওয়া উচিত। আমাদের সময়ে একজন ভিআইপি বন্দীকে কেউ একজন পোশাক পাঠিয়েছিলেন এবং এক কর্মকর্তা তা পৌঁছে দেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ওই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে দিয়েছিলাম। এ ছাড়া যাঁরা টাকাসহ আটক হন, জেল খাটেন, তাঁরা কোথায় এত টাকা পেলেন, কে কে জড়িত এটাও খুঁজে বের করতে হবে। অপরাধ করলে নমনীয়তা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এ অবস্থা উত্তরণে কী করা উচিত?

লিয়াকত আলী খান: কারাগারগুলোর অবস্থা যে পর্যায়ে গেছে, তাতে আমরা মনে করি একটি কারা সংস্কার কমিশন হওয়া উচিত। কারা কমিশন হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে ১৯২০ সালে, পাকিস্তান হওয়ার পর ১৯৫৬ সালে এবং বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৮০ সালে। তারপর ৪০ বছর হয়ে গেলেও কোনো কারা সংস্কার কমিশন হয়নি।