কারাগারের রিপোর্ট বুক যেন অনিয়মের খতিয়ান

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার
ফাইল ছবি

কারাগারে কী না হয়! যে বন্দীকে তালাবদ্ধ করে রাখার কথা, তাঁকে গভীর রাতেও ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। বন্দীদের মধ্যে মাদক–মুঠোফোন তো অনেক দিনের সমস্যা। সুস্থ বন্দীও চাইলে হাসপাতালে মাসের পর মাস আয়েশে থাকার ব্যবস্থা হতে পারে। কারাগার ঘিরে অপরাধ কর্মকাণ্ডের এমন অভিযোগ সব সময়ই ছিল। তবে ৬ জানুয়ারি কাশিমপুর কারাগার–১–এ হল–মার্কের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমদের সঙ্গে এক নারীর সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়ার ঘটনার ভিডিও চিত্র সামনে আসার পর অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

তবে তুষারের ওই ঘটনা জানাজানির আগেই গত সেপ্টেম্বরে কাশিমপুর কারাগার-১-এ যোগ দেওয়া পর জেলার (কারাধ্যক্ষ) নূর মোহাম্মদ মৃধা কারাগারের রিপোর্ট বইয়ে ওই কারাগারের এমন নানা অনিয়মের কথা উল্লেখ করেন। ‘রিপোর্ট/মিনিটস বুক’ নামে ওই বইটি ছক কাটা। ছকের তিনটি অংশ। একটি অংশে জেলার তাঁর পর্যবেক্ষণ লিখবেন, আরেকটি অংশে কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক (সুপারিনটেন্ডেন্ট বা জেল সুপার) জেলারের পর্যবেক্ষণের জবাব দেবেন। আরেকটি অংশে ওই পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো, তার বিবরণ লিখতে হবে।

তবে কারাগারের ওই রেপোর্ট বুকে কেবল জেলার নূর মোহাম্মদের পর্যবেক্ষণই লেখা রয়েছে। সেখানে ওই কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক রত্না রায়ের কোনো জবাব নেই। এসব পর্যবেক্ষণ ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জ্যেষ্ঠ জেল সুপার রত্না রায়ের। কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে ছকের তৃতীয় ঘরটিও খালি। কারাসূত্রগুলো বলছে, জেলার নূর মোহাম্মদও কেবল রেকর্ড বইয়ে লিখে দায়িত্ব শেষ করেছেন। কারাগারের এ দুই কর্মকর্তাই (জেল সুপার ও জেলার) হল-মার্কের জিএমকে নারীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।

রিপোর্ট বুকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর জেলার নূর মোহাম্মদ লিখেছেন, হল-মার্কের জিএম তুষার আহমদ, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি এনএসআইয়ের সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যার ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, বালিশ-কাণ্ডে গ্রেপ্তার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের উপ-প্রকৌশলীকে গভীর রাত পর্যন্ত তালাবদ্ধ (লকআপ) করা হয় না। তাঁদের বিধিবহির্ভূতভাবে রাতের বেলায় ঘোরাফেরা ও খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া হয়। এ কারণে চিত্রা ভবনে অবস্থানরত অন্য বন্দীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। তাঁরা সংক্ষুব্ধ হয়ে জেলারকে বিষয়টি জানিয়েছেনও। জেলার তাঁদের যথাসময়ে তালাবদ্ধ করার নির্দেশ দিতে জেল সুপারের কাছে অনুমতি চান। কিন্তু জেল সুপার রত্না রায় কিছুই জানাননি।

গত ৮ অক্টোবর রেকর্ড বইতে জেলার লিখেছেন, গত ৬ ও ৭ অক্টোবর রাতে কারা অভ্যন্তরের বিভিন্ন ওয়ার্ড তল্লাশি করে বেশ কিছু মুঠোফোন ও সিম উদ্ধার করা হয়। কারাগারের কিছু কর্মচারী ও কর্মকর্তা এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত আছেন। বিশেষ করে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে একই পদে পদায়িত রয়েছেন, তাঁদের দায়িত্ব পরিবর্তন করা একান্ত প্রয়োজন। বন্দীদের কাজের ধরন, ওয়ার্ড ও মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দীদের সেল পরিবর্তন দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। সুষ্ঠু প্রশাসন পরিচালনার জন্য অবৈধ মুঠোফোন ব্যবহার রোধ করা প্রয়োজন।

২ ডিসেম্বর রেকর্ড বইয়ে জেলার লিখেছেন, গত ৩০ নভেম্বর রাত আনুমানিক ১১টা ৫ মিনিটের দিকে কে বা কারা কালো স্কচটেপে মোড়ানো একটি পোঁটলা দেয়ালের ওপর দিয়ে পূর্ব পাশে যমুনা ভবন বরাবর নিক্ষেপ করে। এটি খুললে আনুমানিক ২০০ গ্রাম গাঁজা ও দুটি ছোট মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়। তিনি লেখেন, আলামত হিসেবে বন্দীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা মুঠোফোন কারা অধিদপ্তরে পাঠানো হয় না। জেল সুপার অনুমতি দেননি।

পরস্পরকে দোষারোপ দুই কর্মকর্তার

তুষার–কাণ্ডে জেল সুপার রত্না রায় ও জেলার নূর মোহাম্মদ—দুজনকেই ওই কারাগার থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁরা দুজন এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ তুলছেন। রত্না রায় কারা মহাপরিদর্শককে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, বন্দীকে নারীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দিতে জেলার নূর মোহাম্মদ ১ লাখ টাকা নিয়েছেন। আর ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলায়েন ২৫ হাজার এবং দুই কর্মচারী ৫ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন। যদিও রত্না রায় নিজের সম্পৃক্ততার কথা বলেননি।

আর জেলার নূর মোহাম্মদ বলছেন, হল-মার্কের তুষার ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রত্নার দারুণ সম্পর্ক। রত্না রায় নির্দেশ দেওয়ার পর তিনি (নূর মোহাম্মদ) বন্দীকে নারীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ করে দেন।

যোগাযোগ করা হলে জেলার নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনো অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হননি। যেসব অনিয়ম হচ্ছে, তা লিখে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, ঊর্ধ্বতনেরা তাঁকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেননি।

এ বিষয়ে জানতে রত্না রায়ের সঙ্গে গত দুই দিন যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

কারাগারের দুর্নীতি নিয়ে খোঁজ করতে গিয়ে কথা হয় ওই কারাগারের দুজন নবীন কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারের ভিআইপি আসামিদের স্বজনদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেওয়া, যাচাই-বাছাই না করে আসামিদের সঙ্গে স্বজনদের দেখা করিয়ে দেওয়া—এসব এ কারাগারে নিয়মিতই চলে। এই করোনাকালেও বন্দীদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে স্বজনদের সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কারাগারের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই বোঝা যাবে কারা কারা সাক্ষাৎ করেছেন।

রেকর্ড বুকে নূর মোহাম্মদের লিখিত পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে তাঁরা বলছেন, যখন কেউ দায়িত্ব পেয়ে নতুন আসেন, তখন এ ধরনের ‘ভালো ভালো কথা’ লেখেন। কিন্তু একপর্যায়ে গিয়ে সবাই একই স্রোতে গা ভাসান।

এসব বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজনস) মো. মোমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেখা-সাক্ষাৎ তো হতেই পারে। বন্দী তো তাঁর স্বজনের সঙ্গে দেখা করবেনই। এখন বন্ধ আছে করোনার জন্য। তবে নিয়মবহির্ভূতভাবে যদি কেউ দেখা করেন, তবে দোষী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কারাগারের অন্য অনিয়মগুলো বন্ধ করা হবে।

রেকর্ড বুকে জেলারের লিখে যাওয়া অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আইজি প্রিজনস বলেন, ‘এগুলো আমার আসার আগের অনিয়ম। এগুলো নিয়ে আমি বলতে পারব না।’

২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনেও কাশিমপুর কারাগারে ছয়টি গুরুতর অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপরও পরিস্থিতি পাল্টায়নি।

সাবেক আইজি প্রিজনস লিয়াকত আলী খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মগুলো চলে আসছে। কারাগারের কর্মকর্তা-কমর্চারীরা কারাবিধি মানেন না বলে এ অবস্থা চলছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের সাহস বাড়ছে। এই দায় ঊর্ধ্বতনদেরই।