কারাগারের রোজনামচা: বঙ্গবন্ধু যখন বাবা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের বড় একটি অংশ কেটেছে কারাগারে। জীবনের এই অধ্যায়টি তিনি সেখানে বসেই লিখে গেছেন। সেই লেখাই বই আকারে প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। বইয়ের নাম ‘কারাগারের রোজনামচা’। এই বইয়ে শুধু কারাগারের চিত্রই নয়, ফুটে উঠেছে সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পাকিস্তান সরকারের এক নায়কোচিত মনোভাব ও অত্যাচার-নির্যাতনের নানান চিত্র। ফুটে উঠেছে, একজন বন্দী বাবার আকুতি, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা। দেশ ও মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাবনা, রাজনৈতিক দর্শন।

১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর ওই বছরের প্রথম তিন মাসে বঙ্গবন্ধু মোট আটবার গ্রেপ্তার হয়ে জামিন পান। ৮ মে আবার গ্রেপ্তার হন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ মূলত তাঁর ওই সময়ের কারা জীবনের দিনলিপি। নতুন এই বইয়ের নাম দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা।
বইটির ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে, এ আত্মবিশ্বাস বারবার তাঁর (বঙ্গবন্ধু) লেখায় ফুটে উঠেছে। এত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছেন কি না আমি জানি না।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বারবার বন্দী করেও বঙ্গবন্ধুর মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি। যেমন ১৯৬৬ সালের ৫ জুন তিনি লিখেছেন, ‘তিনি (মোনায়েম খান) ভুলে গেছেন এটা পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তান নহে! আন্দোলন করা এবং নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা এরা রাখে।’ ১২ই জুন লিখেছেন, ‘ভরসা আমার আছে, জনগণের সমর্থন এবং ভালবাসা দুইই আছে আমাদের জন্য। তাই আন্দোলন ও পার্টির কাজ চলবে।’ ওই সময়টাতে ছয় দফা বানচালের জন্য সরকার আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের প্রায় সবাইকে জেলে পুরে দেয়। ১৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘.. সব কয়জন সেক্রেটারিকে নিয়ে এসেছে, এখন একমাত্র মহিলা সম্পাদিকা আমেনা বেগম আছে। জেলখাটা ও কষ্টকরা শিখতে দেও, এতে কর্মীদের মধ্যে ত্যাগের প্রেরণা জাগবে। ত্যাগই তো দরকার। ত্যাগের ভিতর দিয়েই জনগণের মুক্তি আসবে।’

সরকারের দমন-পীড়ন সত্ত্বেও ছয় দফার বিষয়ে শেখ মুজিব ছিলেন অনড়। তিনি লিখেছিলেন, ‘৬ দফা বাদ দিয়া কোনো দলের সাথে আওয়ামী লীগ হাত মেলাতে পারে না। ... যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব।’
বঙ্গবন্ধুর এই বইয়ে ১৯৬৬ সালের কর্তৃত্ববাদী সরকারের চরিত্র ফুটে উঠেছে। ৪ জুন তিনি লিখেছেন, ‘ইত্তেফাক দেখে মনে হলো ৭ই জুনের হরতাল সম্বন্ধে কোনো সংবাদ ছাপাতে পারবে না বলে সরকার হুকুম দিয়েছে।

জন্মের পর থেকে বেশির ভাগ সময় শিশু রাসেল দেখছে, তার বাবা বাসায় থাকেন না। থাকেন কারাগারে। অবুঝ শিশু মনে করেছিল কারাগারটাই তার ‘আব্বার বাড়ি’। মাঝে মধ্যে মায়ের সঙ্গে ‘আব্বার বাড়ি’তে গিয়ে বাবাকে দেখে আসত। ১৯৬৬ সালের ১৫ জুন। রাসেল গিয়েছে বাবাকে দেখতে। বঙ্গবন্ধু সে বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না, যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘‘আব্বা আব্বা’’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘‘আব্বার বাড়ি’’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি।’ বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, ‘৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো’। কি উত্তর ওকে আমি দেব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বুঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে!.....শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’

কারাগারে অন্য বন্দীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু দেখা করা বা কথা বলার সুযোগ পেতেন না। বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় সেটি ওঠে এসেছে এভাবে, ‘কারও সঙ্গে আলাপ করার উপায় নাই। কারও পরামর্শ করারও উপায় নাই। সান্ত্বনা দেবার কেহ নাই। কারাগারের ভিতর একাকী রাখার মতো নিষ্ঠুরতা আর কি হতে পারে?’ আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন ‘...আমাকেও একলা একলা জেলে রেখে পাগল করে দিতে পারবে। আমাকে যারা পাগল করতে চায় তাদের নিজেদেরই পাগল হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।’ আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘লেখাপড়া করতে ইচ্ছা হয় না। সময়ও কাটে না, জেলে রাতটাই বেশি কষ্টের। আবার যারা আমার মতো একাকী নির্জন স্থানে থাকতে বাধ্য হয় যাকে ইংরেজিতে বলে সলিটারি কনফাইয়েনমেন্ট তাদের অবস্থা কল্পনা করা যায় না।’