কালাপেট পানচিলের শেষ আবাস

পদ্মার চরে কালাপেট পানচিল
ছবি: ওমর সাহাদত

মার্চ মাসে যমুনা নদীর পানি একেবারে কমে যায়। চৈত্রের কড়া রোদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে বালুঝড় হয়। ২০১০ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে যমুনা নদীতে গিয়েছিলাম ঘড়িয়াল গবেষণার কাজে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি ঘাট থেকে ছোট নৌকা নিয়ে সোজা উত্তর কর্নিবাড়ির পথে। সারা দিন নদীতে কাটিয়ে একদম ঘাটের কাছাকাছি এসে এক জোড়া পানচিল মাথার ওপর উড়তে দেখলাম। অস্পষ্ট কয়েকটি ছবিও তুললাম। পরে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, এগুলো কালাপেট পানচিল। এর আগে সর্বশেষ ২০০০ সালে এই পাখি দেখার তথ্য ছিল। এরপর পাখি গবেষক বন্ধু সায়েম বছর পাঁচেক পাখিটি খুঁজতে ঘুরে বেড়িয়েছে পদ্মা-যমুনার প্রায় প্রতিটি চর। কিন্তু হদিস মেলেনি।

পদ্মা-যমুনায় এত চর থাকতে পানচিলটি হারিয়ে যাবে ভাবতেই অবাক লাগে। ২০১০ সালের পর পাখিটির আবার হঠাৎ দেখা মিলল ২০১৬ সালে পদ্মায়। ওই বছরের ২৩ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের বাকরআলিতে বাসাও পাওয়া গেল। ডিম ছিল তিনটি। যে চরে পাখিটির দেখা মিলল তার পুরো এলাকা আমরা নজরদারিতে রাখলাম প্রায় সারাটি বছর। পাওয়া গেল বেশ কয়েকটি বাসাসহ পাখি। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, পাখিটি হয়তো এ দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার উপস্থিতি আমাদের সবাইকে স্বস্তি দিল।

কালাপেট পানচিল পৃথিবীব্যাপীই একটি বিপন্ন পাখি। এর ইংরেজি নাম ব্ল্যাক বেলিড টার্ন। দেখতে কিছুটা নদীয়া পানচিলের মতো হলেও প্রজনন মৌসুমে পেটের নিচের ভাগে কালো অংশটা দেখে সহজেই তাকে পৃথক করা যায়। বাংলাদেশের যে ১৩ জাতের পানচিল দেখা যায়, তার মধ্যে সবচেয়ে বিরল কালাপেট পানচিল। বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ৬ হাজার প্রজননক্ষম কালাপেট পানচিল পাখি টিকে আছে, যার বেশির ভাগই দেখা যায় ভারতের নদীগুলোতে। নেপালে আছে মাত্র ১০ জোড়া। নব্বইয়ের দশকের আগে বাংলাদেশের পদ্মা-যমুনায় এই প্রজাতির পাখিটি খুব সহজেই দেখা যেত। কালাপেট পানচিল কিন্তু আমাদের আবাসিক পাখি। নদী হলো এর প্রিয় আবাসস্থল। এই নদীর চর থেকে পাখিটি হারিয়ে যাচ্ছে মানে পৃথিবীর অন্য পরিবেশ থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি এই প্রজাতিকে সংরক্ষণ করতে না পারি, তবে সারা দুনিয়ার মানুষ কিন্তু আমাদেরই দোষ দেবে।

পদ্মা-যমুনার শত শত চরের মধ্যে শিবগঞ্জের বাকরআলিই এখন তাদের শেষ আবাস। পুরো পদ্মা-যমুনা নদীর অংশগুলোই কিন্তু পাখিটির বসবাসের উপযোগী। অথচ তাদের আর দেখা মিলছে না। এই এক টুকরা জায়গা যেখানে তারা টিকে আছে, সেটা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। মানুষের অত্যাচার এই চরগুলোতে কম বলেই তারা এখানে বাসা বানাচ্ছে।

কালাপেট পানচিলের ডিম।

শুধু কালাপেট পানচিলই নয়, চরের অন্য পাখিরাও ভালো নেই। চর দখলই বড় সমস্যা। প্রতি বছরই দেখা যায়, চরের ওপর সাময়িক বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড় কেটে নিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অবৈধ মৎস্য শিকারের ফলে নদীতে ছোট মাছের সংখ্যা কমছে। পানচিলদের প্রধান খাবার ছোট মাছ। তপ্ত বালুচরে পানচিলেরা ডিম পাড়লে তা কুকুরের নজরে পড়ে। গায়ের ছেলেরা ডিম কুড়িয়ে নিয়ে আসে। কাক পাখিও ওত পেতে বসে থাকে ডিমের আশায়। এভাবে পানচিলসহ চরের পাখিগুলোর প্রজনন সাফল্য কমে যাচ্ছে। তাই কালাপেট পানচিলকে আমরা আমাদের প্রধান নদীগুলো থেকে হারিয়ে ফেলতে পারি। খুব দ্রুতই অন্তত কয়েকটি চরকে অভয়ারণ্য করা না গেলে হয়তো অচিরেই পাখিটি এ দেশ থেকে হারিয়ে যাবে।