কালোত্তীর্ণ কাজী মোতাহার হোসেন

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১)। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

‘আপনি বিচিত্র ভাবকে এবং আলোচনার বিষয়কে স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ভাষায় রূপ দিয়ে যে প্রবন্ধগুলি আপনার “সঞ্চরণ” গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন, তা পড়ে পরিতৃপ্ত হয়েছি। আপনার বলবার সাহস এবং চিন্তার স্বকীয়তা সাধুবাদের যোগ্য।’

২ ভাদ্র ১৩৪৪ কাজী মোতাহার হোসেনকে এক চিঠিতে তাঁর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সঞ্চরণ’ সম্পর্কে এ অভিমত জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর আজ থেকে ৯২ বছর আগে (৮ মার্চ ১৯২৮) কলকাতার ১৫ জুলিয়াটোলা স্ট্রিট থেকে ‘প্রিয় মতিহার’ সম্বোধনে কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা নজরুলের চিঠির অংশবিশেষে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক—
‘বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের “মতিহার”। বাদল রাতের বুকের বন্ধু।। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে, সেদিন অন্তত তোমার বুক বিঁধে উঠবে।...তোমার নজরুল’

রবীন্দ্র-নজরুলের প্রগাঢ় প্রীতি আর বিরল বন্ধুত্বে ধন্য কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১) তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার বিষয় হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও পরিসংখ্যানকে বেছে নিয়েছেন। পরিসংখ্যানবিদ্যায় মৌলিক অবদানের বলে অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। সেই ১৯২৬ সালে শহর ঢাকায় সমমনা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’, সে সংগঠনের মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের সম্পাদকও ছিলেন। ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’, এই কেন্দ্রবাণীতে বিকশিত ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’–এর অন্যতম পুরোধা নিজের ‘কবি ও বৈজ্ঞানিক’ প্রবন্ধের মতোই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ আর সাহিত্যরসের সংযোগ সাধন করে গেছেন। ‘সঞ্চরণ’, ‘নজরুল কাব্য-পরিচিতি’র মতো বইয়ের পাশাপাশি প্রণয়ন করেছেন ‘গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস’ কিংবা ‘আলোকবিজ্ঞান’-এর মতো বই। প্লেটোর ‘সিম্পোজিয়াম’ অনুবাদের পাশাপাশি কবিমন তাঁকে তাড়িত করেছে বহু হিন্দি কবিতার বাংলায়নে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদান ও শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবিতে যেমন ছিলেন সোচ্চার, তেমনি পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধেও হয়েছেন বলিষ্ঠ কণ্ঠ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপকরূপে বরিত কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন নিঃশঙ্ক সমাজভাবুক, অনলস জ্ঞানতাপস এবং একজন দক্ষ দাবাড়ু। বহু বিশিষ্টজনের স্মৃতিতে যেমন তাঁর দাবা-মগ্নতার বিষয়টি উঠে এসেছে, তেমনি তাঁর বন্ধু নজরুলের ‘শিউলি-মালা’ গল্পেও আমরা দাবার ঘুঁটি হাতে তাঁর ছায়াচিত্র অনুভব করি।


কাজী মোতাহার হোসেনের জীবনী রচনা করেছেন আবদুল্লাহ আল–মুতী। বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে আবদুল হক (প্রথম দুই খণ্ড) এবং আবুল আহসান চৌধুরীর (পরবর্তী খণ্ডগুলো) সম্পাদনায়। তাঁকে নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন তাঁর গুণী কন্যা সন্‌জীদা খাতুন, আবুল আহসান চৌধুরী, শিখা আরেফীন প্রমুখ।

তবে ব্যতিক্রমী একটি বই ১৯৯৭ সালে কাজী মোতাহারের জন্মশতবর্ষে ‘কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন’–এর পক্ষে সন্‌জীদা খাতুনের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘কাজী মোতাহার হোসেন: আপনজনদের স্মৃতিকথা’ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ: জুলাই ২০১৬, নবযুগ প্রকাশনী)।

সম্পাদক সন্‌জীদা খাতুনের কথায়—
‘আমাদের পরিবার নয় শুধু, কাজী মোতাহার হোসেনের ছাত্র, উত্তরসূরি সাহিত্যিক-দাবাপ্রেমিক, গ্রামবাসী মানুষ—সকলের প্রীতি এবং শ্রদ্ধা এসে মিশেছে এই আপনজনদের কথায়। ভালোবেসে তাঁর নানা বর্ণের ছবি আঁকা হয়েছে এই বইতে।’ সত্যি, ২০০ পৃষ্ঠার বইটি প্রথাগত স্মারকগ্রন্থের শুষ্ক বৃত্ত ভেদ করে হয়ে উঠেছে এক অনন্য-পাঠ্য সজীব সংকলন, যেখানে একজন বরেণ্য ব্যক্তির খুঁটিনাটি বহু বিষয় উপভোগ্য বর্ণনায় উঠে এসেছে।

সরদার জয়েনউদ্‌দীন বর্ণনা করেছেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক থাকাকালে সেখানকার ‘বই’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বইয়ের সমালোচনাসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা। ঘটনা হলো, ‘বই’ পত্রিকায় একটি বইয়ের প্রশংসাসূচক সমালোচনা পড়ে কাজী মোতাহার বইটি কিনেছেন এবং পড়ে দেখেন, এটি মোটেও সমালোচনায় দাবি করা অসাধারণ কোনো বই নয়। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে সরদার জয়েনউদ্‌দীনের অফিসে এসে বললেন—

‘জানো এই বাজে বইখানার জন্যে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। এই সময়টাতে আমি অন্য একখানা ভালো বই পড়া থেকে বঞ্চিত হলাম, অর্থাৎ আমার জীবদ্দশায় একখানা ভালো বই প্রকাশিত হবে আর আমি তা না পড়েই চলে যাব! মানুষের এই অপূরণীয় ক্ষতি তোমরা ভবিষ্যতে আর কোরো না।’

জ্যেষ্ঠ কন্যা যোবায়দা মির্যা লিখেছেন—
‘আব্বুকে কখনো প্রশংসায় বিগলিত হতে দেখিনি৷ বলতেন, “যারা আমার দোষ ধরে, তারাই আমার প্রকৃত হিতৈষী।”’

আরেক কন্যা ফাহমিদা খাতুনের উপলব্ধিতে তিনি আছেন কঠিনের সহজিয়া সাধকস্বরূপে—

‘কখন নিজের অজান্তে আব্বু আমার মনের মধ্যে এই ধারণাটা গেঁথে দিয়েছেন যে আমি ইচ্ছে করলেই অনেক শক্ত কাজও করতে পারি।’

প্রিয় একজন ছাত্র কাজী ফজলুর রহমানের মূল্যায়নে পরিস্ফুট একজন অসাধারণ শিক্ষক ও একজন পরিপূর্ণ মানুষ মোতাহার—
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়—লন্ডন, অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ডে কিছু কিছু সময় কাটানোর সুযোগ আমার হয়েছিল। কর্মজীবনে দেশে ও বিদেশে বহু খ্যাতনামা ব্যক্তির সাথে পরিচিত হয়েছি, কিন্তু ড.কাজী মোতাহার হোসেনের মতো দ্বিতীয় একটি Complete man-সম্পূর্ণ মানুষের দেখা আর পাইনি। খণ্ডিত মানসসত্তা ও একমাত্রিক বিশেষজ্ঞের এই যুগে তিনি একটি বিরল ব্যতিক্রম হয়ে থাকবেন।’

পুত্র কাজী আনোয়ার হোসেনের স্মৃতিতে ভাস্বর একজন জ্ঞানপিপাসু ও জ্ঞানবিতরক বাবার ছবি, যিনি বাইরে থেকে বাসায় ঢুকে ছেলেকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘আজকে কোনটা পড়বি—পাটিগণিত, জ্যামিতি না অ্যালজেব্রা?’ অতঃপর সেই ছেলের রসিক মন্তব্য, ‘ভাবটা যে কোনটা খাবি—সন্দেশ, পান্তুয়া না রসগোল্লা!’

এক দৌহিত্রি নাজমা হক তাঁর মাতামহের মধ্যে বিস্তৃত দেখেছেন অবিকল্প শিক্ষার আদর্শ—
‘নানার সারা জীবনটাই একটা আদর্শ, একটা শিক্ষা। তিনি ছয় ফুট লম্বা ছিলেন, কিন্তু মানুষ হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে তাঁর মান ছিল আরও উঁচু।’

আরেক দৌহিত্রি ইসমাত মির্যা সংগতই লিখেছেন—
‘কাজী মোতাহার হোসেন নিজে কখনো রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হননি। তাই বলে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা কোনো অংশে কম ছিল না।’

কম যে ছিল না বরং কতটা বেশি ছিল, সে প্রমাণ তো পাই নিজের জামাতাকে ঘরে ঢুকতে দেখে ‘কাকে চাই?’ প্রশ্ন করে, পথে নিজ কন্যাকে চিনতে না পেরে অপরিচিত ভদ্রমহিলা-জ্ঞানে সালাম ঠুকে অথবা দূরের যাত্রাপথে ট্রেন থেকে নেমে কোনো দাবার আসরে শামিল হওয়ার গল্পগাথায় ‘অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর’ আখ্যা পাওয়া মানুষটি যখন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সূচনালগ্নেই করেছিলেন এমন দাহদীপ্ত উচ্চারণ—
‘বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয় তবে, সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ, ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না।’

আজ তাঁর জন্মবার্ষিকীতে সন্‌জীদা খাতুনের লেখার সূত্রে ফিরে দেখা যায়, প্রায় চার দশক আগে তাঁর প্রয়াণের দিনটিতে—

‘হাতখানি ধরে বসে রইলাম আমি। মৃত্যুর সঙ্গে বেশ যুঝেছেন। দিন ষোলো কেটেছিল ওই রকম। বুদ্ধির মুক্তি যাঁর আন্দোলনের বিষয় ছিল, কাল তাঁর সর্বচেতনা হরণ করল।’
কাল হরণ করেছে ব্যক্তিমানুষটিকে আর আপনজনদের স্মৃতির অঙ্গন পেরিয়ে মুক্তবুদ্ধির আভায় কালোত্তীর্ণ হয়ে আছেন কাজী মোতাহার হোসেন।